মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো | ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি | সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা প্রশ্ন উওর
মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ |
আজকের এই ব্লগের মাধ্যমে আমি তোমাদের সঙ্গে দশম শ্রেণির ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় " সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা " এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন,যেটা প্রায়শই মাধ্যমিকে এসে থাকে সেটা নিয়ে একটি নোট তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো। এর আগে একটি পোস্টে আমরা -
1- " মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙ্গালী সমাজের মনোভাব,
2- 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল বা ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহীবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল,
3- 1857 সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ বা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ " সম্পর্কে আলোচনা করেছিললাম। আজকে আমরা 1857 খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সম্পর্কে আরও কিছুটা আলোচনা করবো। আজকের এই পোস্টে আমরা " মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো অথবা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি " তা নিয়ে আলোচনা করবো।
ক্লাস টেনের ইতিহাস বইয়ে " মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ " সম্পর্কে সেরকম ভাবেও আলোচনা করা হয়নি। তাই আজকের এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমরা ক্লাস টেনের ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় " সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা বড় প্রশ্ন উত্তর " হিসেবে " মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ বা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি " তোমাদের নোট শেয়ার করবো।
মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো |১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি
ভূমিকা : 1857 খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের 1858 খ্রিষ্টাব্দে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত সময় বহু ঐতিহাসিক, অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সিপাহী বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। এবং তারা প্রত্যেকে সিপাহী বিদ্রোহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন চরিত্র ও প্রকৃতি নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের,বিভিন্ন ঐতিহাসিক অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যেভাবে তার চরিত্র ও প্রকৃতি নির্ধারণ বিশ্লেষন করার চেষ্টা করেছেন,তাদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য মতবাদ হলো -
◆ শুধুমাত্র সিপাহী বিদ্রোহ :
স্যার জনকে, লরেন্স, পি.ই. রবার্টস, ম্যালেস প্রমুখ ইংরেজ ঐতিহাসিক এবং দাদাভাই নৌরজি, দুর্গাদাস ব্যানার্জী প্রমুখ মতে " 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল " শুধুমাত্র সিপাহী বিদ্রোহ।
তাদের মতে 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র সিপাহিদের নিজস্ব কিছু কারণে। সিপাহীদের দ্বারা শুরু হওয়া এবং সিপাহীদের দ্বারা পরিচালিত মহাবিদ্রোহে সেরকমভাবে কোনো জাতীয় উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল না। সিপাহী বিদ্রোহের বেশিরভাগটাই পরিচালিত হয়েছিল সিপাহিদের দ্বারা।। এই বিদ্রোহ সেরকমভাবেও সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করেনি। এবং তার চেয়েও বড়ো কথা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিপাহী বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে জনগণ ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে ছিল।
◆ জাতীয় বিদ্রোহ : কার্ল মার্কস, জে.বি.নর্টন, আলেকজান্ডার ডাফ প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ছিল একটি জাতীয় বিদ্রোহ। এটা ঠিক যে মহাবিদ্রোহে ভারতের সব জায়গার জনগণ সেরকম ভাবেও অংশগ্রহণ করেনি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিপাহীবিদ্রোহ জনগণের সমর্থন করতে পারেনি। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ন অঞ্চলের জনসাধারণ সিপাহী বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল এবং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল। এবং তারা মহাবিদ্রোহকে ফল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছিল। প্রথমদিকে সিপাহী বিদ্রোহ হয়তো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যায়নি কিন্তু পরবর্তীতে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের অংশগ্রহণের পরে, বিদ্রোহীদের লক্ষ্যে হয়ে দাঁড়িয়েছিল অত্যাচারী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসান ঘটিয়ে তাদের বিতাড়িত করা।
◆ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ :
প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামােদর সাভারকার তার 1857 খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি তার " Indian War of Independence " গ্রন্থে এই তত্ত্বের অবতারণা করেছেন।
বিনায়ক দামোদর সাভারকর এর মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে উত্তর ও মধ্য ভারতের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাতি,বর্ণ,ধর্ম নির্বিশেষে যেভাবে যোগদান করেছিল,তা ইতিপূর্বে ভারতে আর ঘটেনি। উত্তর ও মধ্য ভারতের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহাবিদ্রোহে যোগ দিয়ে, বিদ্রোহের মাধ্যমে তারা ভারত থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসান ঘটিয়ে তাদের বিতাড়িত করতে চেয়েছিল। অর্থাৎ তারা স্বাধীনতা লাভ করার মানসিকতা নিয়েই মহাবিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছিল।
◆ সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া : বিখ্যাত বামপন্থী চিন্তাবিদ রজনীপাম দত্ত, মানবেন্দ্রনাথ রায় বা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য,অধ্যাপক সুশোভন সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে মহাবিদ্রোহ ছিল সামন্ততান্ত্রিক এবং রক্ষণশীল শক্তিগুলির অভ্যুত্থান। তাদের মতে তাতিয়া টোপি, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ ক্ষমতাচ্যুত সামন্তরাজারা যারা নিজের নিজের এলাকার সাধারণ জনগণকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে বিদ্রোহে সামিল করেছিল। ডঃ মজুমদার মহাবিদ্রোহকে ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত তন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্ত শ্রেণির মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
◆ সাম্প্রদায়িক আন্দোলন : আলফ্রেড লায়াল ছাড়াও আরো অনেকে মহাবিদ্রোহকে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলে মনে করেন। কারণ তাদের মতে 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ শুরু হয়েছিল এনফিল্ড রাইফেলের টোটার ব্যবহারকে কেন্দ্র করে। যদিও মহাবিদ্রোহের পেছনে আরও নানা কারণ ছিল কিন্তু মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেলের টোটার ব্যবহার। এনফিল্ড রাইফেলের টোটার ব্যবহারের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে কর্মরত হিন্দু এবং মুসলিম সেনাদের ধর্মীয় বিষয় যুক্ত ছিল বলে তারা এই বিদ্রোহের শামিল হয়েছিল। তাই আলফ্রেড লায়াল ছাড়াও আরও অনেকের 1857 খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ছিল শুধুমাত্র একটি সাম্প্রদায়িক আন্দোলন।
◆ গণবিদ্রোহ : ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেনের মতে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে গণবিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন তারমধ্যে এই বিদ্রোহ ভারতের সর্ব সব জায়গায় জনগণের অংশগ্রহণ না করলেও অযোধ্যা বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল
◆ 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মত এই যে - 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি। সকল শ্রেণীর জনগণও তেমন ভাবে অংশগ্রহণ করেনি।। তাই 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে না ছিল কোনো জাতীয় বিদ্রোহ, না ছিল কোনো স্বাধীনতার যুদ্ধ আর না ছিল এটা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ।
উপসংহার : সবশেষে বলা যায়, 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ এতোটাও সহজ নয়। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের মধ্যে একাধিক চরিত্র ও প্রকৃতি লুকিয়ে ছিল। যা কখনোই হয়তো নির্দিষ্ট করে তুলে ধরা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে কেমব্রিজ ঐতিহাসিক সি.এ.বেইলির মতে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ কেবল একটি আন্দোলন নয়,,এর মধ্যে কৃষক অভ্যুত্থান বা জাতীয় বিদ্রোহের আরও আরও অনেক কিছুই ছিল। " The Indian Rebellion of 1857 was not one movement….it was many ".
আশাকরি যে উপরের আলোচনা থেকে তোমরা ক্লাস টেনের ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা এর " মহাবিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ বা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি " সেই সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পেরেছো। এই অধ্যায়ের পরবর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে পরবর্তীকালে শেয়ার করব।
Tags :