তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো | বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমীরের ভূমিকা

0


তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো | বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমীরের ভূমিকা


তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করো | বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমীরের ভূমিকা

বারাসাত বিদ্রোহ কি বা বারাসাত বিদ্রোহ বলতে কি বোঝো বা বারাসাত বিদ্রোহ কাকে বলে? বা বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন 

ভূমিকা : ভারতের ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত ওয়ালীউল্লাহ এবং তার পত্র আজিজ এর মাধ্যমে। কিন্তু ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় সৈয়দ আহমেদকে। মক্কায় হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমেদের স্বাধীন্নে আসেন বাংলার তিতুমীর বা মীর নিসার আলী  সৈয়দ আহমেদের কাছে ওয়াহাবী আন্দোলন সম্পর্কে শুনে তিনি তাঁর আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। এবং এরপর তিতুমীর বাংলায় ফিরে এসে দরিদ্র ও নির্যাতিত সাধারণ মুসলিম কৃষকদের নিয়ে তিনি তাঁল ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন।


বারাসাত বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল? 

বারাসাত বিদ্রোহের বিস্তার : তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ ছিল মূলত যশোহর, 24 পরগনা,মালদহ,রাজশাহী-ঢাকা এবং পাবনার সহ আরো বেশ কিছু অঞ্চলে। 

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের তিতুমীরের ভূমিকা | তিতুমীরের বারাসার বিদ্রোহ 

বিদ্রোহের সূচনা : তিতুমীর কৃষকদের অত্যাচারী জমিদার মহাজন' এবং নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে তার বারাসাত বিদ্রোহ শুরু করে।  তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা বলা মুশকিল। তবে ধরা হয় যে বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল 1825 খ্রিষ্টাব্দের দিকে। তবে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ এর পরেই মূলত তার এই বিদ্রোহ মোটামুটি ভাবে তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। তিতুমীর বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করার পর সেখানে তার সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর  মৈনুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং গোলাম মাসুমকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করার পর, বাশের কেল্লা থেকে তিনি বাদশাহ হিসেবে নিজের কাজ করতে শুরু করেন। তিতুমীরের অনুগামীরা হেদায়াতি নামে পরিচিত ছিল। তিতুমীর যে সমস্ত অঞ্চল গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন,,সেখানে না তার অনুগামীরা ব্রিটিশ সরকারকে খাজনা দেবেনা বলে ঘোষণা করে। এবং তিতুমীরকে নিজেদের পালনকর্তা হিসেবে খাজনা দিতে শুরু করে। এবং এভাবেই মূলত ধীরে ধীরে তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হয় । 


কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে বিরোধ : বারাসাত অঞ্চলে ওয়াহাবীদের প্রভাব কম করার জন্য সেখানকার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মুসলিমদের উপর অথবা ওহাবীদের ওপর এক ধরনের ধর্মীয় করা আরোপ করে। সেটা ছিল তাদের দাড়ির উপর আড়াই টাকা কর বৃদ্ধি করা। এই ঘটনার পর তিতুমীর ও তার অনুগামীরা কৃষ্ণদেব রায়ের প্রতি খুব বাজেভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। এবং তার ফলেই তিতুমীরের সঙ্গে কৃষ্ণদেব রায়ের সংঘর্ষ বাঁধে। 

বাঁশের কেল্লা নির্মাণ : বিদ্রোহ তিতুমীরের বিদ্রোহ ঘোষণা করার পর বারাসাত,,বসিরহাটের বিভিন্ন অঞ্চলে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেখানে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করেন।তিনি সেখানে নিজেকে বাদশাহ এবং  মুৈনুদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী এবং গোলাম মাসুদকে নিজের সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর তিতুমীর নারকেলবেরিয়া গ্রামে তিনি তার বাঁশেরকেল্লা বাসেখানে তিনি নিজের প্রাসাদ গড়ে তোলেন। এবং সেটাই হয় তার প্রধান দপ্তর। 

তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের লক্ষ্য কী ছিল? | তিতুমীরের বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য

তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল একাধিক. যেমন - 

প্রথমত : বারাসাত বিদ্রোহ ছিল অত্যাচারিত এবং নির্যাতিত মুসলিম কৃষকদের নিয়ে। তাদের বিদ্রোহ ছিল মূলত অত্যাচারী জমিদার, মহাজনদ এবং নীলকরদের শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সুতরাং তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল জমিদার, মহাজন এবং নীলকর সাহেবদের শোষন অত্যাচার থেকে মুক্তিলাভ। 

দ্বিতীয়তঃ অত্যাকারী জমিদার,মহাজন এবং নীলকর সাহেবদের শোষণ ও শাষন থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের বিতাড়িত করা। 


তৃতীয়ত : তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ যে সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল, তিতুমীর চেয়েছিল যে,সেখানে যেন শুধুমাত্র তাঁরই শাসন থাকে। অর্থাৎ তিতুমীর সেসব অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেখানে নিজস্ব শাষন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। সেখান সেকারণেই তিতুমীর নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করেছিল। অর্থাৎ সেখানে শুধুমাত্র তিতুমীরের শাসন চলবে। 

চতুর্থত : জমিদার,মহাজন এবং নীলকরদের দ্বারা অত্যাচারিত ও শোষিত কৃষকদের নিয়ে তিতুমীর এমন একটি স্বাধীনরাজ গড়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন, যেখানে ব্রিটিশদের কোনো প্রকার শাষন অত্যাচার থাকবে না। অর্থাৎ সেটা হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন যেখানে শুধুমাত্র তিতুমীর এবং তিতুমীরের অনুগামীদের কথা চলবে।

বারাসাত বিদ্রোহের অবসান 

 তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ ঠিক কবে শুরু হয়েছিল সেটা সঠিকভাবে না জানা গেলেও মনে করা যে বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল 1825 খ্রিষ্টাব্দে। এবং খ্রিস্টাব্দে 1831 খ্রিস্টাব্দের 14 নভেম্বর তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের সম্পূর্ণ অবসান ঘটেছিল। জমিদার এবং নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে বিদ্রোহ করার ফলে জমিদার এবং নীলকররা তিতুমীরের এই বারবারন্ত সহ্য করতে পারেনি। ফলে তারা যৌথভাবে সরকারের কাছে এই বিদ্রোহ দমনের জন্য আবেদন জানায়।। জমিদার, মহাজন এবং  নীলকরদের কথা মেনে কথা,, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সেনাবাহিনীকে তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ দমন করার জন্য পাঠায়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কামানের গোলায়, নারকেলবেড়িয়া গ্রামে অবস্থিত তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই তিতুমীরের মৃত্যু ঘটে । এই যুদ্ধের তিতুমীরের প্রায় 800 জনেরও বেশি অনুগামীরা বন্দি হন। এবং গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। যার ফলে তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়।


তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ কি ছিল? | বারাসাত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল কেন?

ভূমিকা : অত্যাচারী জমিদার,মহাজন? এবং ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে, তিতুমীর অত্যাচারিত এবং শোষিত মুসলিম কৃষকদের নিয়ে যে বারাসাত বিদ্রোহ শুরু করেছিল তার শেষপর্যন্ত সফল হতে পারেনি। তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের ব্যর্থতার পেছনে একাধিক কারণ ছিল। যেমন -

নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব : তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের ব্যর্থতার এটি অন্যতম কারণ ছিল, বিদ্রোহকে কিভাবে সঠিক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বিদ্রোহীদের হাতে ছিল না। 

◆ অসহযোগিতা : তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাইরে থেকে কোনো সাহায্য সে পায়নি। তার বিদ্রোহ ধর্মীয় মোড়কে মোড়া হলেও উচ্চবর্ণের মুসলিমরাও সেই বিদ্রোহে যোগদান করে তাকে সহযোগিতা করেনি। 

◆ জনসমর্থনের অভাব : যেকোনো একটি বিদ্রোহ শক্তিশালী হওয়ার জন্য তার চাই জনসমর্থন। কারণ জনগণের সমর্থনের মাধ্যমেই যে কোনো বিদ্রোহ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ঠিক সেরকমই তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহেরও জন সমর্থন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যেই যে পরিমাণ জনসমর্থন বারাসাত বিদ্রোহের প্রয়োজন ছিল, সেই পরিমাণ জনসমর্থন বারাসাত বিদ্রোহ লাভ করতে পারেনি।। নিম্নমানের মুসলমান সমাজের মানুষ ছাড়া অন্য কোনো সমাজের মানুষই সেরকম ভাবেও অংশগ্রহণ করেনি। এমনকি উচ্চবিত্ত মুসলমান সমাজও তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহে থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। 


◆ দুর্বল বিদ্রোহ : তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এই বিদ্রোহে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সেরকম ভাবেও অংশগ্রহণ করেনি।  বিশেষ করে হিন্দু সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষজন। হিন্দু কৃষিজীবী মানুষরা এবং অন্যান্য নিম্নস্তরের মানুষরা বারাসাত বিদ্রোহ থেকে দূরে থাকায়, বারাসাত বিদ্রোহ সেরকমভাবে জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি।

◆ আধুনিক অস্ত্রের অভাব : বারাসাত বিদ্রোহের ব্যর্থতার সবচাইতে বড় কারণ ছিল তিতুমীরের কাছে সেই পরিমাণ আধুনিক অস্ত্র ছিল না, যেটা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। 1831 খ্রিস্টাব্দের 14 ই নভেম্বর যখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সামনে আসে এবং গোলার আঘাতে বাশেরকেলা ধ্বংস করতে শুরু করে, তখন তাদের আটকানোর জন্য তিতুমীরের কাছে সেরকম কোনো অস্ত্র ছিল না যার মাধ্যমে তিতুমীর তাদের আটকাতে পারতো। এবং আধুনিক অস্ত্রের অভাবের জন্যই তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top