আজকেই ব্লগ পোস্টে মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায় বা দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং উপনিবেশ সমূহ অধ্যায় থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন "ক্রিপস মিশন কি? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবসমূহ এবং এর ব্যর্থতার কারণ লেখো।" এর উওর তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো।।
ক্রিপস মিশন কি? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবসমূহ এবং এর ব্যর্থতার কারণ লেখো।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের দিকে জাপানের সাড়াশি আক্রমণের ফলে ইউরোপের মিত্রশক্তির দেশ গুলি নাজেহাল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেন বুঝতে পারে যে, ইউরোপ এবং ভারতে অক্ষশক্তির দেশগুলির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করতে গেলে ভারতের শক্তি এবং সম্পদ ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ বর্তমান পরিস্থিতির ভিত্তিতে কখনোই ভারতীয় সম্পদকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করতে দেবে না। এই কারণে ব্রিটিশ সরকার স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় নেতাদের সামনে কিছু প্রস্তাব রেখে তাদের সন্তুষ্ট করে ভারতীয় শক্তি ও সম্পদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে সফল করতে ব্রিটিশ সরকার বিশিষ্ট সমাজসেবী ও খ্যাতনামা স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে মার্চ দিল্লিতে পাঠান। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের এই দিল্লি আগমন স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস মিশন বা ক্রিপস দৌত্য নামে পরিচিত।।
ক্রিপস মিশনের ভারতে আসার কারণ-
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে মার্চ ক্রিপস মিশনের ভারতে আসার পেছনে মূলত দুই থেকে তিনটি প্রধান কারণ ছিল। যেমন-
প্রথম কারণ ছিল ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন জাপানের আক্রমণে ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, ঠিক তখন ব্রিটিশরা উপলব্ধি করতে পারে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনকে জিততে হলে একার শক্তি যথেষ্ট নয়। সেই কারণেই যুদ্ধে ব্রিটেন কে ভারতের শক্তি এবং সম্পদ উভয় ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ কখনোই বর্তমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতকে যুক্ত করবে না। এই কারণে তাদের কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে আগে ঠান্ডা করতে হবে। দ্বিতীয় কারণ ছিল,১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের দিকে চীনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই-শেখ ভারত সফরে আসেন। তিনি ফিরে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে জানান যে ভারত সম্পর্কে ব্রিটেনের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন না হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া অসম্ভব হয়ে যাবে। এরপর সবদিক চিন্তা করে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইস্টন চার্চিলকে চাপ দিতে শুরু করেন। ঠিক এই সময়টাতেই ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন দানের উদ্দেশ্যে কিছু ব্রিটিশ রাজনীতিবিদও চার্চিলের ওপর চাপ দিতে শুরু করেন। এভাবে পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে মার্চ ক্রিপশ মিশনকে ভারতে পাঠান।।
ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব গুলি কী কী ছিল?
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে আলোচনার পর তাঁদের কাছে ২৯ মার্চ একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাব ক্রিপস প্রস্তাব' নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবে বলা হয় যে,
• যুদ্ধের পর ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন’-এর মর্যাদা দেওয়া হবে।
• যুদ্ধের পর ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে।
• সংবিধান সভার সদস্যগণ প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত এবং দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় রাজাদের দ্বারা মনোনীত হবেন।
• এই সংবিধান সভা ভারতের নতুন সংবিধান রচনা করবে।
• ভারতের কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য এই সংবিধান গ্রহণে রাজি না হলে সেই প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য নিজের সংবিধান রচনা করবে।
• সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ওপর ব্রিটিশ সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে।
• ভারতীয়দের সহযোগিতায় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সম্পদ যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করবে।
• বড়োলাটের কার্যনির্বাহী পরিষদে আপাতত বেশি সংখ্যক ভারতীয় সদস্য নেওয়া হবে।
ক্রিপসের মিশনের ব্যর্থতার কারণ বা ক্রিপস মিশন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
আপাতদৃষ্টিতে ক্রিপস মেশিনের প্রস্তাবগুলি ভারতীয়দের পক্ষে কল্যাণকর বলে মনে হলেও, ভারতীয়রা ক্রিপস মিশনের এই প্রস্তাবগুলি গ্রহণ করেনি। কারণ তৎকালীন সময় ভারতের কিছু প্রধান রাজনৈতিক দল যেমন জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি ক্রিপস মিশনে সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
• কারণ যেমন ক্রিপস মিশনের বিরোধিতা করার পেছনে কংগ্রেসের প্রধান কারণ ছিল- ক্রিপস মিশনের মাধ্যমে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের বিষয়ে কোন কথা বলা হয়নি।
• দ্বিতীয়ত মুসলিম লীগ ক্রিপস মিশনের বিরোধিতা করেছিল এই কারণে যে,ক্রিপস মিশন মুসলিম লীগের দাবি অর্থাৎ পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কোন কথা বলেনি। তৃতীয়তঃ হিন্দু মহাসভা, শিখদের এই ভয় ছিল যে, মুসলিমরা যদি আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে,তাহলে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। মূলত এই সমস্ত কারণে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়েছিল। ক্রিপস মিশন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৪২ খ্রিস্টাবের ১১ই এপ্রিল ক্রিপস তার প্রস্তাব বাতিল করেন এবং একটি বেতার ভাষণের কংগ্রেসকে দোষারোপ করে তিনি ইংল্যান্ড ফিরে যান।।