![]() |
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কাকে বলে? এর পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি দাও |
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কাকে বলে? এর পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি দাও।
অথবা,
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ব্যাখ্যা করো। 'পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভবও নয়, সমীচীনও নয়'- আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্র হল একটি রাজনৈতিক বিমূর্ত ধারণা সরকার হলো সেই রাষ্ট্রের বাস্তব বা মূর্ত রুপ। তাই রাষ্ট্রের আদর্শ,ন্যায্য উদ্দেশ্য এবং ইচ্ছা সরকারের মাধ্যমে রূপায়িত হয়। ফলে সরকারকে প্রচুর কাজকর্ম এবং দায়িত্ব পালন করতে হয়। সরকারের তিনটি বিভাগ রয়েছে। যথা - আইন বিভাগ শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। আইন বিভাগ আইন তৈরি করে,শাসন বিভাগ সেই আইন প্রয়োগ করে এবং বিচার বিভাগ সেই আইনের ব্যাখ্যা করে এবং যদি কেউ ভঙ্গ করে তাহলে তাকে শাস্তি প্রদান করে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে বোঝায়,সরকারের তিনটি বিভাগের অর্থাৎ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং অনিয়ন্ত্রিত অবস্থান যার দ্বারা স্বৈরতন্ত্র রোগ হবে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষিত হবে। ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্ক রচিত, 1748 খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত The Spirit Of The Laws গ্রন্থে সর্বপ্রথম ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। এছাড়াও পরবর্তীতে ইংরেজ রাষ্ট্র দার্শনিক ব্ল্যাকস্টোন তার ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত Commentaries Of The Laws Of England নামক গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের স্বপক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। অবশ্য প্রাচীনকালেও মন্তেস্ক এবং ব্ল্যাক স্টোনের আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল,রোমান পলিবিয়াস, সিসেরো, ফরাসি দার্শনিক জা বোদা,জন লক, হারিংটন প্রমুখ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন।।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির বৈশিষ্ট্যঃ-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কয়েকটি প্রধান নীতি বা বৈশিষ্ট্য হলো -
• প্রথমত সরকারের তিনটি বিভাগ অর্থাৎ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে।
• দ্বিতীয়ত আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ অন্য কোনো বিভাগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না।
• তৃতীয়ত সরকারের এই তিনটি বিভাগের একটি বিভাগ অপর কোন বিভাগের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ সংক্রান্ত বিতর্কঃ-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতি বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব কিনা এই নিয়ে প্রথম থেকে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই এই নীতিকে সমর্থন করলেও অনেকে তা সমর্থন করেন না। কারণ অনেক মনে করেন,সরকারের ক্ষমতা এবং কাজকর্মকে সরকারের এই তিনটি বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রথম সাফল্য লক্ষ্য করা যায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। এই নীতিকে আমেরিকার কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। অবশ্যই মার্কিন সংবিধানেই আবার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি বা Checks & Balance নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। যাইহোক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির পক্ষে এবং বিপক্ষে যে মতামত গুলো দেওয়া হয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির স্বপক্ষে যুক্তিঃ
কয়েকজন রাষ্ট্র দার্শনিক ক্ষমতা সতন্ত্রীকরন নীতির স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলি দিয়েছেন, তা হল-
সরকারি কাজে সুবিধাঃ-
অনেকে মনে করেন সরকারের কার্যাবলী রূপায়ণের সুবিধার জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির প্রয়োগ একান্তভাবে কাম্য। সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলী বিভিন্ন বিভাগের হাতে তুলে দিলে সরকারি কাজে যেমন সুবিধা হয়,তেমনি তার কার্যাবলী সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষাঃ
ফাঁসি দার্শনিক মন্তেস্ক বলেছেন, কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে আইন রচনা ও শাসন ক্ষমতা থাকলে জনগণের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। তাছাড়া আইন ও শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করা না হলে ব্যক্তি স্বাধীনতা বিনষ্ট হবে।
দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধিঃ-
সরকারের তিনটি বিভাগকে পৃথক পৃথক কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হলে, তিনটি বিভাগের কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
স্বৈরতন্ত্র রোধঃ-
সরকারের তিনটি বিভাগ নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং অপর বিভাগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় স্বৈরতন্ত্রের সম্ভাবনা কম থাকে। এবং স্বেচ্ছাচারিতাও বন্ধ হয়।।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির বিপক্ষে যুক্তিঃ
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির স্বপক্ষে যেমন বিভিন্ন যুক্তি রয়েছে, ঠিক তেমনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির বিপক্ষেও বিভিন্ন যুক্তি রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য যুক্তি হলো-
মূল তত্ত্বে গলদঃ-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির তীব্র সমালোচনায় বলা হয়,ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূলেই ভুল রয়েছে। ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্কু সরকারের যে তিনটি বিভাগ নিয়ে ক্ষমতা নীতির কথা বলেছেন,তার মূলে ভ্রান্তি রয়েছে। কারণ আপাতদৃষ্টিতে সরকারের তিনটি বিভাগ মনে হলেও,বাস্তবে প্রত্যেক বিভাগের বিভিন্ন উপবিভাগ রয়েছে।
কর্মসূচি রূপায়ণে পারস্পরিক সহযোগিতাঃ
সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো কর্মসূচি ও আদর্শকে রূপায়িত করা নাকি প্রত্যেক বিভাগের স্বতন্ত্র রক্ষা করা। তাই সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি রুপায়িত করতে হলে সরকারের প্রত্যেক বিভাগের পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত ভাবে প্রয়োজন।
জটিল পরিস্থিতিঃ
বর্তমানে প্রত্যেক সরকারের জাতীয় সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আরো জটিল হয়েছে। এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। কিন্তু এই অবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগ করলে সরকারের স্থায়িত্ব এবং অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে।
বাস্তবে প্রয়োগ অসম্ভবঃ
বাস্তবে আলোচ্য নীতির কঠোর প্রয়োগ সম্ভব নয়। কারণ প্রকৃতপক্ষে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ বিশেষ করে প্রথম দুটি বিভাগ পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারেনা। তাই তাদের বিভাজন সম্ভব নয়।
উপসংহারঃ
পূর্বোক্ত সমালোচনা ও ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা যায় না। কারণ এই নীতির কিছু ভালো দিক আছে। সম্ভবত এই কারণেই মন্তেস্কুর মৃত্যুর কয়েকশো বছর পরেও তার নীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে।।