মন্ত্রী মিশন কী? মন্ত্রী মিশনের ত্রুটি ও গুরুত্ব আলোচনা করো
উওরঃ ১৯৪৫ সালে সাধারণ নির্বাচনে উইস্টন চার্চিল পরাজিত হন এবং শ্রমিক দলের নেতা ক্লিমেন্ট এটলি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও পেথিক লরেন্স ভারত সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। ক্লিমেন্ট এটলি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং পেথিক লরেন্স ভারত সচিব পদে নিযুক্ত হওয়ার পরেই তারা ভারতের স্বাধীনতা বা ভারতের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন। ভারতের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ভারতের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তারা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে একটি প্রতিনিধি দলকে শীঘ্রই ভারতের পাঠানোর পরিকল্পনা করেন। এই বিষয়ে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সায় দিলে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিনজন সদস্যকে নিয়ে একটি প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়। সেই দলের সদস্যরা ছিলেন স্যার পেথিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, এবং এ.ভি.আলেকজান্ডার। এই তিনজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত দলটি মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন নামে পরিচিত।
মন্ত্রী মিশনের ভারতে আগমনঃ-
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিনজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ২৪ শে মার্চ দিল্লিতে আসেন। এরপর তারা ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে ১৮২ টি বৈঠক করেন এবং বিভিন্ন স্থানীয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করেন।
মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবসমূহঃ-
মন্ত্রী মিশন তার পরিকল্পনায় জানায় যে-
• ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে।
• প্রদেশগুলিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হবে এবং কেন্দ্রের হাতে কেবলমাত্র পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব থাকবে।
• হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলিকে 'ক', মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলিকে 'খ' এবং বাংলা ও আসামকে 'গ' শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
• প্রদেশগুলি নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই রচনা করবে এবং ইচ্ছে করলে একই স্বার্থবিশিষ্ট প্রদেশগুলি (যথা—ক, খ, গ) জোট বাঁধতে পারবে।
• প্রত্যেক শ্রেণি (ক, খ, গ) ও দেশীয় রাজ্যগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান সভা বা গণপরিষদ গঠিত হবে। এই গণপরিষদ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র রচনা করবে।
• শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার শাসন পরিচালনা করবে।
মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবসমূহের প্রতিক্রিয়াঃ-
মন্ত্রীমশনের যে প্রস্তাব সমূহ পেশ করা হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়া একেক রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এক এক রকম ছিল।
যেমন- মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াঃ- মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবসমূহের মুসলিমদের নিয়ে পৃথক খ পরদেশ গঠন করার কথা বলা হলে, এতে মুসলিম লীগের পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবি কিছুটা স্বীকার করে নেওয়া হয়। যার ফলে মুসলিম লীগ মুসলিম সেনের পরিকল্পনাকে সমর্থন জানায়।
কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াঃ- মন্ত্রী মিশন এর প্রস্তাবে সরাসরি ভাবে পৃথক পাকিস্তানের রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়নি বলে কংগ্রেস এই প্রসাবকে সমর্থন জানায়। তবে এই প্রস্তাবের সাম্প্রদায়িক নীতির প্রাধান্য থাকায় কংগ্রেস অন্তর্বতীকালীন সরকারের যোগ দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু সংবিধান সভায় যোগ দিতে রাজি হয়।।
মন্ত্রী মিশন প্রস্তাবের কিছু ত্রুটিঃ-
মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলিতে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা যায়। এই ত্রুটিগুলি হল—
পাকিস্তানের পদধ্বনিঃ এই প্রস্তাবে সরাসরি ভারত বিভাজন বা পৃথক পাকিস্তানের দাবিকে স্বীকার না করা হলেও প্রদেশগুলিকে হিন্দুপ্রধান ও মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে ভাগ করে এবং তাদের জোট বাঁধার অধিকার দিয়ে পরোক্ষে ভারত বিভাজনের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জিন্নার মনে হয়েছিল, এটা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ।
দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রঃ কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রাদেশিক সরকারের তুলনায় দুর্বল করার ফলে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনেক দুর্বল হয়ে যায়।
দুর্বল অন্তবর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাবঃ- প্রস্তাবিত অন্তবর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বাত্মক ক্ষমতা দানের কোনো প্রস্তাব এতে ছিল না।
দুর্বল সংবিধান সভা গঠনের প্রস্তাবঃ-
সংবিধান সভা বা গণপরিষদকে নতুন সংবিধান রচনার জন্য সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পরে অবশ্য মন্ত্রী মিশন একটি ইস্তাহার প্রকাশ করে জানায় যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংবিধান সভাকে যতটা সম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হবে।
মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনার কয়েকটি গুরুত্বঃ-
কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও এই প্রস্তাবগুলির যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। এই গুরুত্বগুলি হল—
ভারতের অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়াসঁঃ-
মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা ছিল ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতকে অবিভক্ত রেখে স্বাধীনতা দেওয়ার শেষ আন্তরিক প্রয়াস। মন্ত্রী মিশন স্পষ্টই উপলব্ধি করেছিল যে, ভারত বিভাজনের দ্বারা সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে না।
দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিত্বঃ- এই পরিকল্পনার দ্বারাই সর্বপ্রথম দেশীয় রাজ্যের জনগণকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
জটিলতা হ্রাসঃ- এতদিন পর্যন্ত ইউরোপীয়, ইঙ্গ-ভারতীয় খ্রিস্টান, তপশিলি জাতি প্রভৃতি বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে কেন্দ্র করে শাসনতান্ত্রিক আলোচনায় অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি হত। কিন্তু মন্ত্রী মিশন হিন্দু, মুসলিম এবং পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে শিখ ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে জটিলতা অনেক হ্রাস পায়।
ভারতীয়করণঃ- গণপরিষদে কোনো অভারতীয় সদস্য গ্রহণের ব্যবস্থা না রাখার ফলে তাতে সম্পূর্ণ ভারতীয়করণ ঘটে।
গণপরিষদের ক্ষমতাঃ- ভারতের নতুন সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদকে সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়।