একাদশ শ্রেণির ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় প্রশ্ন উএর |
আজকের এই ব্লগে আমরা একাদশ শ্রেণির ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও তার শাসনযন্ত্র ( WB Class 11 history chapter 4 question answers in bengali ) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বা বিষয় 'দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র কী ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র ছিল? বা সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন ছিল?' বিস্তারে আলোচনা করবো। এবং এই বিষয়ে একটি সুন্দর নোট তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো।
দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র কী ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র ছিল? || সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন ছিল?
ভূমিকাঃ- সাধারণ দিক থেকে দেখতে গেলে দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যেতে পারে। কিন্তু দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক বিচার বিশ্লেষণ করলে দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র ছিল কিনা অথবা দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়। যেমন-
সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী ছিল কিনা তার স্বপক্ষে যুক্তিঃ-
সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনী তার ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থের সুলতানি রাষ্ট্রকে জাহান্দারি অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু ডঃ রামশরণ শর্মা, ডক্টর আর.পি. ত্রিপাঠি সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করেছেন। এর স্বপক্ষে যে যুক্তি গুলো দেওয়া হয়,হলো-
খলিফার প্রতি আনুগত্যঃ-
দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি যে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের মতো ছিল, তার স্বপক্ষে সবচাইতে বড় যুক্তি হলো- হজরত মহম্মদের মৃত্যুর (৬৩২ খ্রি.) পরবর্তীকালে মুসলিম জগতের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু ও শাসক হিসেবে খলিফাতন্ত্রের উত্থান ঘটে। শরিয়ত অনুসারে, অন্যান্য মুসলিম শাসকরা খলিফার অনুগত নায়েবমাত্র। দিল্লির অধিকাংশ সুলতান খলিফার প্রতি তাঁদের আনুগত্য জানিয়ে নিজেদের খলিফার ভৃত্য বলে পরিচয় দিতেন। এছাড়াও আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া দিল্লির সব সুলতানই খলিফার স্বীকৃতি গ্রহণ করেন। ইলতুৎমিস ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফার স্বীকৃতি লাভ করেন। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে খলিফাতন্ত্রের পতন ঘটলেও দিল্লির সুলতানগণ খলিফার প্রতি তাঁদের আনুগত্যের বন্ধন ছিন্ন করেননি। তাঁরা নিজেদের ‘খলিফার সহকারী' হিসেবে পরিচয় দিতেন, মুদ্রায় খলিফার নাম খোদাই করতেন এবং খলিফার নামে ‘খুত্বা’ পাঠ করতেন।
উলেমা শ্রেণীর গুরুত্বঃ-
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, শাসক তার শাসন ব্যবস্থায় উলেমাশ্রেনির গুরুত্বকে স্বীকার করেন। সম্রাট উলেমাশ্রেনির বা পুরোহিত শ্রেণীর নির্দেশমতো তার শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে থাকেন। দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এরুপ উলেমাশ্রেনির গুরুত্ব লক্ষ্য করা যেত।।
দিল্লি সুলতানি শাসন ব্যবস্থায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসনের এবং বিচার বিভাগের উচ্চ পদ গুলো উলেমাশ্রেণির লোকেরা দখল করতো। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সুলতানরা, উলেমা শ্রেণীকে খুশি করার জন্য অনেক সময় তাদের ভূমি দান করতেন, তাদের মসজিদ নির্মাণ করতেন এবং মাঝে মধ্যে হিন্দুদেরও বিরোধিতা করতেন।।
শরিয়তের গুরুত্বঃ
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের মনুষ্যসৃষ্ট আইনের গুরুত্ব চেয়ে ধর্মীয় আইন বা নিয়মকানুন গুরুত্ব বেশি থাকে। দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন যে, সুলতানি আমলে সামাজিক আইনগুলি ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্র শরিয়তের বিধান অনুসারে রচিত হয়েছিল। শরিয়তের ভিত্তিতে উলেমা শ্রেণি সুলতানকে যে ১২টি কর্তব্য পালনের পরামর্শ দিয়েছেন তা মহম্মদ-বিন-তুঘলক ছাড়া অন্য সকল সুলতানই মেনে চলতেন।
ইসলামি করব্যবস্থাঃ-
ভারতবর্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দেশ হলেও শরিয়তে নির্দেশিত করব্যবস্থা এদেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেছেন যে, শরিয়তের বিধান অনুসারে সুলতানি করব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল।। এছাড়াও অ-মুসলিমরা মুসলিম শাসনে ‘জিম্মি' হিসেবে পরিগণিত হত এবং তাদের কাছ থেকে ‘জিজিয়া কর’ আদায় করা হত।
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে যুক্তিঃ-
উপরোক্ত কিছু আলোচনা থেকে দিল্লির সুলতানি শাসন ব্যবস্থাকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলে মনে হলেও ডক্টর সতীশচন্দ্র, ডঃ মোঃ হাবিব, ডঃ হাবিব উল্লাহ প্রমুখ দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে কোনভাবেই ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করেন না। তাদের মতে, দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত ছিল যা একে ধর্মাশ্রয়ী হিসেবে প্রমাণ করে না। যেমন-
সুলতান হলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারীঃ-
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র অনুসারে ঈশ্বর হলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফাদের স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের সুলতানি শাসনকালে শরীয়তের বিধান অনুসারে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক কোন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এবং এক্ষেত্রে সুলতানরাই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তারা কিছু ক্ষেত্রে ধর্মকে প্রাধান্য দিললেও তাদের শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ধর্মকে কখনোই প্রাধান্য দেননি।
খলিফাদের প্রতি আপাত আনুগত্য প্রদর্শনঃ-
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের খলিফাদের অনেক প্রভাব থাকে এবং সুলতানকে খলিফাদের প্রতি চরম আনুগত্য প্রদর্শন করতে হতো। কিন্তু দিল্লির সুলতানদের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি এরূপ আনুগত্য প্রদর্শন করতে দেখা যায়নি। তারা কিছু ক্ষেত্রে তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কারণে ছিল।
শরিয়ত-বহির্ভূত নির্দেশঃ-
সুলতানি শাসনকালে শরিয়তের বিধান লঙ্ঘনের বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন-
• শরিয়তে মুসলিমদের প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ হলেও অধিকাংশ সুলতানের আমলেই মুসলিমদের প্রাণদণ্ডের প্রথা চালু ছিল।
• শরিয়তে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ হলেও ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রয়োজনে সুলতানি আমলে ঋণদান ও সুদগ্ৰহণ চলত।
• শরিয়তের বিধান অনুসারে মুসলিম রাষ্ট্রে পৌত্তলিকদের কোনো স্থান না থাকলেও সুলতানি আমলে পৌত্তলিক হিন্দুদের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল।
• মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী অ-মুসলিমদের ‘জিজিয়া কর দানের নিয়ম থাকলেও সুলতানি রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ, মহিলা, শিশু ও অসহায় ব্যক্তিরা ‘জিজিয়া’ প্রদান থেকে অব্যাহতি পেতেন।
• শরিয়তের ব্যাখ্যাকর্তা উলেমা শ্রেণিও সুলতানের কাছ থেকে সর্বদা ভালো ব্যবহার পেতেন না। একদা ঘটনা প্রসঙ্গে আলাউদ্দিন খলজি কাজি মুঘিসুদ্দিনকে জানান যে, “কোন্টি শরিয়তের বিধানসম্মত, কোন্টি বিধানসম্মত নয় তা আমি জানি না। রাষ্ট্রের পক্ষে যা কল্যাণকর বা আপৎকালে যা জরুরি বলে আমার মনে হয়, আমি তা-ই করি।”
সুলতানের স্বাধীনতাঃ-
ইসলামি আইন অনুসারে সমগ্র কিন্তু মুসলিম ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জগতের প্রধান হলেন খলিফা। অন্যান্য মুসলিম শাসকগণ তাঁর নায়েব মাত্র। ভারতের সুলতানি শাসনে খলিফার এরূপ সীমাহীন ক্ষমতা স্বীকৃতি লাভ করেনি। এখানে কোনো কোনো সুলতান রাজনৈতিক প্রয়োজনে নিজেকে ‘খলিফার প্রতিনিধি’ বলে প্রচার করেছেন মাত্র। বাস্তবে দিল্লির সুলতান ছিলেন। সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ধর্মীয় বিষয় অপেক্ষা সুলতানগণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বেশি নজর দিতেন বলে অধ্যাপক নুরুল হাসান উল্লেখ করেছেন।
হিন্দুদের গুরুত্বঃ-
সুলতানি শাসকগণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও এই সময় ভারতে হিন্দুরা একেবারে গুরুত্বহীন ছিল না। কোনো কোনো সুলতান রাজকার্যের উচ্চপদে হিন্দুদের নিয়োগ করতেন। সুলতানি শাসনকালে ভারতের সর্বত্র বহু ছোটো ছোটো হিন্দু সামন্ত রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। স্থানীয় প্রশাসনে হিন্দুরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। গ্রামীণ প্রশাসনেও হিন্দুদের একাধিপত্য ছিল। তা ছাড়া সুলতানগণ তাঁদের শাসনকে কখনোই ইসলামীয় শাসন বলে ঘোষণা করেননি।
উপসংহারঃ- সুতরাং সব দিক বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায় দিল্লি সুলতানি শাসন ছিল সামরিক বাহিনীর দ্বারা এবং দিল্লি সুলতানি শাসনের যোগ্যতা এবং বুদ্ধির সাহায্যে গঠিত একটি সাম্রাজ্য যেখানে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ হলেও দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্য ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র ছিল না। এজন্য ডক্টর সতীশচন্দ্র সুলতানি রাষ্ট্রকে সামরিক এবং অভিজাত তান্ত্রিক বলে অভিহিত করেছেন এবং ডক্টর মুজিব সুলতানি রাষ্ট্রকে প্রকৃতিগতভাবে স্বৈরতান্ত্রিক এবং এককেন্দ্রিক বলে উল্লেখ করেছেন।।
আশাকরি যে, একাদশ শ্রেণির ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও তার শাসনযন্ত্র 'দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র কী ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র ছিল? বা সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন ছিল?' সম্পর্কে যে নোট শেয়ার করা হয়েছে, তা তোমাদের কাজে লাগবে।
Tags :
wb class 11 history question answer | একাদশ শ্রেণির ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর | wb class 11 history suggestion 2023 | একাদশ শ্রেণির ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায় বড় প্রশ্ন উএর | WB Class 11 History Question Answer & Notes | Class 11 History 8 Mark Question Answer | wb Class 11 History Notes | WB Class 11 History Suggestion 2022