আশাপূর্ণা দেবীর ছোটগল্প - অর্থহীন || Bangla Short Stories By Ashapurna Debi

0

 

আশাপূর্ণা দেবীর ছোটগল্প - অর্থহীন || Bangla Short Stories By Ashapurna Debi
Bangla Short Stories By Ashapurna Debi


আজকের এই ব্লগের মাধ্যমে আমরা আশাপূর্ণা দেবীর ছোট গল্প ( Bengali Short Stories Of Ashapunra Debi) হিসেবে অর্থহীন ( Arthahin By Ashapurna Debi) নামক একটি ছোট বাংলা গল্প আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব। পরবর্তীকালে আমরা আশাপূর্ণা দেবী সহ অন্যান্য বিখ্যাত লেখক লেখিকাদের বিভিন্ন ধরনের বাংলা ছোটগল্প এবং বিভিন্ন উপন্যাসের গল্প আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো।

আশাপূর্ণা দেবীর ছোটগল্প - অর্থহীন

ওদের দুজনকে পাশাপাশি 'সিটে' বসে সিনেমা দেখতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আশ্চর্য, লোকে কত গুজবই রটাতে পারে। যদিও আমি শুধু ওদের পিঠই দেখতে পাচ্ছি, তবুও চিনতে ভুল করেছি এ হতেই পারে না। ওদের সঙ্গে চার পাঁচটা বছর একই বাড়িতে বাস করেছি।

সেটা বোধ হয় বছর দশেক আগের কথা না ওরই কাছাকাছি, নতুন বিয়ে হয়ে আসা আনাড়ি এই দম্পতিটি আমাদেরই নীচের তলার দু'খানা ঘরের রাজ্যে সংসার পেতে বসেছিল। ঘর দুটো ভাড়া দেওয়া, সত্যি বলতে আমাদের দরকারে নয়, ওদেরই দরকারে। আমার ভাইপো বিনুর সঙ্গে বন্ধুত্ব সূত্রে কেমন করে যেন জেনে ফেলেছিল ওরা, নীচতলার ওই দক্ষিণ চাপা ঘর দুটো আমাদের এমনিই পড়ে থাকে, ব্যবহারে লাগে না। এসে ধরে পড়ল ছেলেটি দিতেই হবে, ঘরণী জুটেছে ঘর জোটেনি, প্রায় একটা বেসামাল অবস্থায় কাটাচ্ছে।

প্রেমঘটিত বিয়ের ভাগ্যে প্রায়শই যা হয় আমাদের সমাজে। এ কুলে ওকুলে কোনও কুলেই তেমন সমাদর সম্ভ্রমের ঠাই জোটে না। অতএব মান বাঁচানোর দায়ে ঘর করবার জন্যে ঘর খুঁজে বেড়ানো। ঘর দুটো দক্ষিণ চাপা?

হোক হোক তাই যথেষ্ট। ওদের কাছে আপাতত ওই স্বর্গ। দক্ষিণা হাওয়া তো তাদের নিজেদের মধ্যেই প্রচুর রয়েছে। তবে অনুভা ওই নীচতলাটায় খুব কমই থাকত, যতক্ষণ অমলেশ বাড়িতে থাকত শুধু ততক্ষণই। পালিয়ে আসত দোতলায়। হয়তো সংসারের কোনও কাজ হাতে নিয়েই সেলাই নিয়ে, বোনা নিয়ে, কোটবার জন্যে কুটনো নিয়ে, কাকর বাছতে চাল নিয়ে। বলত 'একা একা ভয় করে বাবা।'

আসলে বুঝতাম আমাদের এই সাজানো গোছানো দোতলাটা ওকে টানে। সুন্দরভাবে থাকবার ইচ্ছেটা ওর প্রবল। সেটা খুব স্বাভাবিকও, কারণ অনুভা বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে।

কথায় কথায় প্রায়ই ওর মুখে সে কথা এসে পড়ত। 'বাবার ভীষণ ঘর সাজানো বাতিক, ওই নিয়ে মার সঙ্গে লাঠালাঠি। মা সব সময় বলবে, “এত কী দরকার? এই তো বেশ সোফা সেটটি ছিল, আবার সে সব বদলে নতুন কেন? গেরস্থ ঘরে ডানলোপিলোর গদিতে কী দরকার? দরজা জানালায় এত দামি দামি পর্দা ঝুলিয়ে কী স্বর্গলাভ হবে তোমার ? ও টাকা জমিয়ে রাখলে মেয়ের বিয়েতে কাজে লাগত'—ফিকে ফিকে একটু হাসত অনুভা এরকম সময়, বলত–বাবা বলত, 'তোমার মেয়ের বিয়ের টাকা কি আমি রাখিনি ভেবেছ? দেখো কী ঘটাটি করি!—অনুর বিয়েতে এমন ফার্নিচার দেব, জামাই ব্যাটার তাক লেগে যাবে।' ওই রকমই কথা বাবার — তারপর আবার একটু হেসে উঠত, 'তা এমন বিয়ে ঘটল মেয়ের, বাবার কাছ থেকে লবডঙ্কা।'

এ হাসিটা যেন চেষ্টা করে জোরালো করা। আমি বলতাম, 'তা হোক গে—তোমার নিজেরই সব হবে। বাবার জামাই-ই করবে সব কিছু। বাড়ি, গাড়ি দামি ফার্নিচার।'

তাতে কিন্তু অনুভা অবিশ্বাসের হাসিও হাসত না, হতাশার কথাও বলত না, বরং সোৎসাহেই বলত, 'আমিও তো তাই বলি ওকে, না হবার কী আছে? মানুষই তো করে এসব। আমার বাবা কী? একেবারে সেলফ-মেড ম্যান। বাবার বাবার তো কিছু ছিল না। ও কেবল হেসে উড়িয়ে দেয়। আমি কিন্তু বিশ্বাস রাখি। তা ছাড়া আমি নিজেও কিছু করব, বি-এ-টা অবিশ্যি পাস করা হয়ে ওঠেনি। তাতে কী? কত রকমের চাকরি আছে জগতে। মেয়েদের জন্যে আজ-কাল অনেক দরজা খোলা।

অবিশ্যি অনুভার সামনে চট করে তেমন কোনও দরজা খুলে যায়নি, খোলার কথা বললে

একটু ঘুরঘুলি বলা যায়। পাড়ার একটা সেলাই স্কুলে সেলাই শিক্ষিকার চাকরি জুটিয়েছিল একটা, যার মাইনের

অঙ্কটা মুখে বলতে বাধে। তবু অনুভা তাতেই খুশি। তবু তো কিছু বাড়তি। সেই 'বাড়তি' টুকুর খেয়া নৌকায় সে তার ইচ্ছেয় সমুদ্র পাড়ি দেবার সাধনা চালিয়ে চলেছিল। অনুভার সাধনায় তাদের সেই দক্ষিণা চাপা ছোট ঘর দু'খানিই 'দিব্যরূপ' ধারণ "করেছিল। প্রথমেই একখানা পাখা ভাড়া করে ফেলেছিল অনুভা, তারপর সেই পাখার পিছন পিছন যেন পাখা মেলে উড়ে উড়ে এসে পড়ছিল, হালকা বেতের চেয়ার টেবিল, সুন্দর ছাপের ছিটের পর্দা, রং লাগিয়ে ভব্যসভ্য করা প্যাকিং কাঠের জাল আলমারি, বইয়ের র‍্যাক, ছোট টুকটুক সৌখিন জিনিস। অনুভার হাতের গুণে সামান্য উপকরণেই ঘরের চেহারা মনোরম হয়ে উঠেছিল।

মনে আছে, একদিন আমি হেসে বললাম, 'তোমাদের এই সংসারের একটা নামকরণ করে ফেলো।' অনুভা মহোৎসাহে বলে উঠল, 'বেশ আপনিই একটা নামকরণ করে দিন।' বললাম, 'ধরো-মুখীড়।' কিম্বা 'ভালোবাসার ঘর।

শেষেরটা, শেষেরটাই সুন্দর।' বলল অনুভা। অমলেশ হেসে বলল, ঠিক আছে কালই তাহলে একটা সাইন বোর্ডের অর্ডার দিই, নামটা লিখিয়ে নিয়ে এসে দরজার মাথায় ঝুলিয়ে দেব।' অনুভা রাগ দেখিয়ে বলল, 'সাইন বোর্ড? এ কী দোকান নাকি? নেমপ্লেট বলবে তো? 'ওই হল বলে হো হো করে হাসল অমলেশ। ভারি সুন্দর হাসিটা অমলেশের।

কনি পরে একদিন তেমনি হাসির সঙ্গে বলল, 'নাঃ নেমপ্লেটটার নাম বদল করতে হবে।' 

অনুভা ঝলসে ওঠে, 'হল কই? তাই বদল

'আহা একেবারে সঠিক নাম রাখাই তো ভালো। আমার তো মনে হয় নাম রাখা উচিত 'চাহিদা ঘর।'

'তার মানে?' অনুভার চোখ গোলাকার। 'মানে খুব সোজা। এ ঘরের চাহিদা তো ফুরোতে দেখছি না, একটা মিটলেই আর একটা

কিছুর বায়না।

অতএব—'

চাহিদাটা অবশ্যই ঘরের জন্যে কিন্তু আসামি তো ঘরণি, কাজেই অনুভা রেগে রসাতল করে। বলে, 'সাজিয়ে গুছিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না তোমার? আশ্চর্য।'

অমলেশ বলে, ইচ্ছে কেন করবে না? কিন্তু কোথাও তো থামতে হবে? এই তো বেশ

সাজানো গোছানো হয়েছে, আবার তোমার ঘরের টেবল ফ্যানের বায়না।'

অনুভার যুক্তি সেই তো একটা লড়বড়ে শব্দ ঘ্যান যেনে পাখার জন্যে মাস মাস এক মুঠো করে টাকা ভাড়া যাচ্ছে, অথচ গোড়ায় একটু খরচ করলেই ইনস্টলমেন্টে পাখাটা কিনে ফেলা যায়। যুক্তিটা ফেলনা নয়, কিন্তু অমলেশ বলে অবিরত যদি চাহিদার তালিকা বাড়াতে থাকো

তুমি আর তার পিছনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে থাকো তো 'সুখনীড়টা আর হল কখন?

লতাহলে বলো কর্মক্ষেত্র। অথবা রণক্ষেত্র।

'আমার ওতেই সুখ', বলে শেষ রায় দেয় অনুভা। অতএব মাস পড়লেই দেখা যায়, মাস কাবারি বাজারের সঙ্গে সঙ্গেই অনুভা অমলেশ ঘরের জন্য কিছু একটা কিনে এনে হাজির করছে। আর দেখা যেত উৎসাহটা অমলেশের বেশি।

তার মানে মতান্তরটা ওদের সুখের বিলাস, কথা কাটাকাটিটা আহ্লাদের বিকাশ। ওদের ঘিরে সর্বদাই যেন একটু সুখ আর আহ্লাদের পরিমণ্ডল। নীচের তলার ওই তুচ্ছ ঘর দুটোকে স্বর্গ তুল্য করেই যাপন করে ছিল ওরা চার পাঁচটা

বছর, তারপর অমলেশের চাকরিতে প্রমোশন হল, আর অনুভা নিজেই একটা সেলাই শিক্ষণ কেন্দ্র খুলল, অতএব ওরা দক্ষিণ খোলা দোতলার ফ্ল্যাটে উঠে গেল।

কিন্তু আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক উঠিয়ে দেয়নি, যখন তখন বেড়াতে আসত সময় পেলেই।

হাসি গল্পে খানিকটা সময় হালকা করে দিয়ে যেত। আমিও গিয়েছি মাঝে মাঝে। দেখেছি, আরও কত কী করেছে অনুভা। ওদের ফ্রিজ হয়েছে, গডরেজের আলমারি হয়েছে, জোড়া খাট হয়েছে। গ্যাসের স্টোভ, প্রেসার কুকার। অমলেশ বলত, 'অনু ওর বাবার অপরাধের জরিমানা দিচ্ছে বুঝলেন? ওর বাবার জামাইকে যা যা দেওয়া উচিত ছিল, ও তার সবই প্রায় দিয়ে চলেছে আমায়।'

অনুভা বলত, 'আহা রে আমি যেন সবই নিজের টাকা থেকে করেছি। দু'জনের আয় থেকে গুছিয়ে সংসার চালিয়ে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে করেছি।'

আমি বলতাম, 'সেটাও তোমারই দেওয়া। গুছিয়ে সংসার করে টাকা বাঁচানো কি সোজা ক্রেডিট?'

অনুভা হাসত। সাফল্যের হাসি। মনে হত এবার ওদের সংসারের নামকরণ করা যায় 'সুখনীড়।'

কিন্তু অনুভার ওই সাফল্যের আর সুখের অন্তরালে যে আর একটি পিপাসা আর একটি শূন্যতা জন্ম নিয়েছিল সেটাও টের পাচ্ছিলাম। এতদিন বিয়ে হয়েছে অনুভার, সে মা হয়নি। 

অনুভা একটু ইতস্তত করে বলল, 'না, সেখানেই আছি।' তবে চলো পৌঁছে দিই। উঠে এস আমার গাড়িতে। যেতে যেতে গল্প হবে। কতদিন পরে কলকাতায় ফিরলাম। কই, অমলেশ কই? কোন দিক দিয়ে বেরোল? দেখো দেখো আবার না ট্যাক্সি ধরতে ছোটে।

ভীড় ঠেলে ঠেলে বেরিয়ে আসছিলাম।

তাকাচ্ছিলাম এদিক-ওদিক, অমলেশ হঠাৎ চোখ ছাড়া হয়ে কোন দিকে গেল?

অনুভা কিন্তু চলেছে নির্বিকার। আমার গাড়ির কাছে এসে পড়ে ব্যস্তভাবে বললাম, 'কোন দিকে গেল বলতো?' আমি সেই ট্যাক্সি ধরার কথাই ভাবছিলাম।

অনুভা গাড়ির দরজায় হাত রেখে আমার চোখে চোখ না ফেলে অদ্ভুত একটা বর্ণহীন স্বরে

বলল, 'ও ওর বাসায় চলে গেছে।'

আমার সারা শরীরটা হঠাৎ কাঁটা দিয়ে উঠল। আমার বিনুর কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু তা হলে? এই একত্রে সিনেমা দেখা ?

অন্ধকারের সুযোগে কোলের ওপর হাত রাখা? এটা কী রহস্য? রহস্য ভেদ হল আস্তে আস্তে। অনুভাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ওর ফ্ল্যাটেই এলাম। সেই দক্ষিণ খোলা দোতলার ফ্ল্যাট। সেই খাট, আলমারি, ফ্রিজ, গ্যাস, প্রেসার কুকার, আলগা সেলফ সম্বলিত দু ঘরের সংসার। যেখানে যেমন সাজানো ছিল ঠিক তাই রয়েছে। শুধু সব কিছুর ওপর ধুলো শুধু পর্দা কুশান বেড কভার ময়লা ময়লা। শুধু সংসারে দু'জনের মধ্যে একজন মাত্র।

'হ্যাঁ বিনুদার কথাই ঠিক—' বলল অনুভা, 'আমরা আর এক নেই।' রুদ্ধশ্বাসে বলি, 'কিন্তু এটা কী করে সম্ভব হল অনুভা?'

অনুভা আস্তে বলল, 'আমিও এখন তাই ভাবি কী করে সম্ভব হল। অথচ হয়েও গেল।'

'কিন্তু এত বড় একটা ব্যাপারের কারণ তো কিছু থাকবে? 'কারণ ছিল না, 'কারণ' সৃষ্টি করা হল—' অনুভা কেমন এক রকম হেসে বলল, 'আইনও যেমন আছে, তেমনি আইনের ফাঁকও আছে ইচ্ছে করে চেষ্টা করে ও দোষী সাজল, অথচ –' অনুভা মাথা হেঁট করে বলল, 'সব দোষ আমারই।' হঠাৎ একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল। আমিও চুপ, অনুভাও চুপ।

কিছুক্ষণ পরে অনুভাই আবার কথা বলল, 'ভূতে পাওয়া' কথাটা হাসির বলেই জানতাম, দেখলাম কথাটা হেসে ওড়াবার নয়, নিজের জীবনেই দেখলাম। ভূতেই পেয়েছিল আমায়। এখন ভাবি কি নির্লজ্জতাই করেছি। অথচ তখন মনে হয়েছিল বাচ্চা কাচ্চাহীন সংসার একেবারে অর্থহীন। আমার মনে হয়েছিল—এই না হওয়াটার জন্যে ওই দায়ী। ওর ত্রুটির জন্যে আমার জীবনের সম্পূর্ণতা এল না। অন্ধের মতো ওই ভাবনাটার মধ্যেই নিজেকে একেবারে সমর্পণ করে বসলাম, আর কী যে এক নিষ্ঠুতায় পেয়ে বসল আমায়, উঠতে বসতে অভিযোগ অসন্তোষ শুরু করে দিলাম তারপর অনুভা স্নান হাসির সঙ্গে বলল, 'আপনি হয়তো আমাকে খুবই নির্লজ্জ ভাবছেন। আর সত্যি তো তাই। নির্লজ্জ না হলে ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করি।—ও কেবলই বলেছে ঈশ্বর

আমাদের যা দেননি, তাই নিয়ে এত অশান্তি পাও কেন? যা দিয়েছেন, সেটাই কি কম? আমাদের দু'জনকে তো দিয়েছেন দু'জনের জন্যে।'—কিন্তু আমার তখন ওই কথাগুলো খুব ছেঁদো মনে হত। রাগ করে বলতাম, নিজের ত্রুটি ঈশ্বরের ওপর চাপালে অনেক সুবিধে। বেশ প্রমাণিত হোক ঈশ্বর আমাকেই দেননি। তোমার তো চাহিদা নেই, আমারই চাহিদা অতএব জানা দরকার।'

আমি ওর সিঁদুরবিহীন সিথি সম্বলিত হেঁট করা মাথাটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “থাক, অনুভা, তোমার বলতে কষ্ট হচ্ছে।' সিঁদুর পরাটা অনুভার একটা আর্ট ছিল। খুব সরু অথচ অনেকটা টানা। কপালের ওপর থেকে একেবারে প্রায় মাথার পিছন পর্যন্ত। যেন সিঁথিটাই প্রায় অস্পষ্ট।

অনুভা আবার কুমারী জীবনে ফিরে গেছে। অনুভা আস্তে বলল, 'প্রকৃত কথাটা কাউকে বলতে না পারা আরও কষ্ট। নিজের অপরাধের ভার বহে বহে থামল একটু। তারপর আবার বলতে লাগল, 'সে যাক, ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল, ডাক্তার বলল, ত্রুটি আমারই মধ্যে। 'মা' হওয়ার যোগ্যতা আমার মধ্যে নেই। ওই রায় শুনে, লজ্জায় দুঃখে অপমানে হঠাৎ ক্ষেপে উঠলাম আমি। এতদিন ধরে ওকে যা কিছু বলেছি, যত কিছু অভিযোগ করেছি, তার ধিক্কার আর গ্লানি যেন বুকের মধ্যে হাতুড়ি বসাতে লাগল, সেই আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলাম না, জ্বালায় ছটফটিয়ে বলে বসলাম, 'ডাক্তারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতেই বা অসুবিধে কি? ঘুষ দিতে পারলে সবাইকে কেনা যায়'—শুনে ও হঠাৎ যেন পাথর হয়ে গেল। কতদিন কত নিষ্ঠুর কথা বলেছি। কত রূঢ় ব্যবহার করেছি, এ রকম মুখ কোনওদিন দেখিনি।'—অনেকক্ষণ ওইভাবে বসে থেকে শুধু বলল, “বিশ্বাস চলে গেলে আর কী থাকে?'

তারপর থেকে ও একেবারে আমার সংস্রব ত্যাগ করল, কোথায় থাকে, কোথায় খায়, মাঝে মাঝে এসে টেবিলের ওপর কিছু টাকা রেখে চলে যায়, কথা বলে না। সেই অপমানের টাকা আমিই বা নেব কেন? আর নিয়েই বা করব কী? আমি কি রাঁধছি খাচ্ছি? দিনের পর দিন শুধু চা খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি।—ভয়ানক একটা অভিমানে আমিও পাথর। না হয় মুখ ফস্কে একটা কথা বলেই ফেলেছি, তার কি ক্ষমা নেই?—কিন্তু ক্ষমা তো দূরের কথা, ও অন্য পথ ধরল। অর্থাৎ উচ্ছন্নের পথ ধরল। আমারই সেলাই স্কুলের একটা বাচাল বিধবা মেয়ের সঙ্গে এমন বাড়াবাড়ি মেলামেশা করতে শুরু করল যে, লোকের কাছে মুখ দেখানো ভার হল। মেয়েটাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলাম, কিন্তু সে উল্টো চাপ দিয়ে শাসিয়ে গেল নালিশ করবে। কারণ কারণ না সেকথা মুখে আনতে পারছি না আপনার সামনে। হ্যাঁ, এইভাবেই শোধ নিল অমলেশ। নিজেকে ধ্বংস করে প্রমাণ করল সে খাঁটি।—কিন্তু আমি তখন মরিয়া। ও যে এভাবে শোধ নিতে পারে এ আমার ধারণার বাইরে ছিল, কিন্তু এখন ভাবি কেনই বা তা' ছিল? অমলেশও রক্তমাংসের মানুষ ওকে আমি যে 'অপমান করেছি, তার তো পরিমাপ হয় কিংবা ওরও আর ফেরার পথ ছিল না- তারপর সে অনেক নির্লজ্জ কাহিনী, নিজের চরিত্রহীনতা প্রমাণ করে নিজেই ও আমাকে দিয়ে ডিভোর্সের মামলা আনাতে বাধ্য করল, করণ সেই মেয়েটা তখন ওকে বিয়ে করতে বাধ্য করাচ্ছে। তারপর আর কি? এই তো বেছেন। সেলাই স্কুলটা ভালোই চলছে, কাজেই আমারও চলে যাচ্ছে।' 

'আর অমলেশ ?' বলে ফেলি আমি।

অনুভা আস্তে বলে, 'সেই তার সঙ্গেই আছে। বড়লোকের একমাত্র মেয়ে, অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিল তাই শূন্যতা কমাতে সেলাই শিখতে এসেছিল, এখন তো আবার সধবা হয়েছে। স্বামী পুত্তুর নিয়ে সুখে আছে।

অনুভার কথার ভঙ্গিতে যেন অঙ্ক মিলিয়ে ফেলার নিশ্চিন্ততা।— কিন্তু অঙ্কটা মিলল কই? এ যে একটা ধাঁধার অঙ্ক হয়ে খোঁচা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণে যা শুনলাম তার মধ্যে এই দুজনে সিনেমা দেখতে আসাটা আসে কোথা থেকে? সেটা?

সেটা নাকি দৈবের ঘটনা মাত্র।

মানে, শুরুটা—

থেমে থেমে আস্তে আস্তে অনুভা যা বলল, তার সারমর্ম — একা বাড়িতে সন্ধেবেলাটা অসহ্য লাগে বলে মাঝে মাঝেই সিনেমায় চলে আসত অনুভা, হঠাৎ একদিন দেখতে পেল, পাশের সিটের লোকটা অমলেশ।

বুঝতে পেরে ছুটে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল অনুভা, তারপরই ভাবল, কেন যাব? ওকে

তো তাহলে অনেকটা মূল্য দেওয়া হয়, চেপে বসে থাকব শেষ পর্যন্ত, দেখি ও কী করে।

কিছুই করেনি অমলেশ। বুঝতে পেরেছে, এমনও বোঝা যায়নি। শুধু উঠে দাঁড়িয়ে পড়ার

আগে একটু আস্তে আস্তে করে বলেছিল, কত আজে বাজে লোকই তো পাশে বসে

অনুভা কিছু বলতে পারেনি, ঠিক সেই সময়েই অনুভার গলাটা কেমন বুজে গিয়েছিল।

বাড়ি ফিরে অনুভা ঠিক করল, আর কোনওদিন সিনেমা যাবে না। কিন্তু ক'দিন পরেই

ডাকের খামে এক লাইন চিঠির সঙ্গে মেট্রোর টিকিট একখানা। বেশ দামি সিটের। চিঠিটায়

লেখা, 'খুব কি অসম্ভব? ক্ষতি কী?' অনুভার সর্বশরীর প্রথমটা হিম হয়ে গেল, তারপর আগুনের মতো জ্বলে উঠল। ভাবল টিকিটটা টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়। তারপর চিন্তা করে দেখল ওতে কোনও ফল হবে না; অমলেশ হয়তো ভাববে ডাকের গোলযোগ, ভাববে অনুভার শরীর খারাপ, ওর সামনে গিয়েই ছিঁড়তে হবে।

সেটার জন্য অতএব যেতেই হল।

কিন্তু হল-এর দরজার কাছেই অমলেশ অনুভাকে দেখে তার ভার মুখটা এত উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে, ঠিক সেই মুহূর্তে চিঠিটা ছেঁড়া যেন বোকার মতো দেখতে লাগবে, এটাই মনে হচ্ছে অনুভার। কোনও কথাবার্তা নেই দেখে আসা।

তারপর আবার।

তারপর আবার। সেই একই পদ্ধতি চিঠির ভাষাটার অদল বদল। হয়তো কোনও দিন, 'ছবিটা শুনেছি অপূর্ব, না দেখাটা লোকশান। হয়তো ছবিটার দুটো কাগজে দুরকম সমালোচনা বেরিয়েছে, আসলে কী দেখা দরকার।' হয়তো বা 'তোমার' ফেভারিট নায়কের ছবি, তাই ফার্স্ট শোতেই ব্যবস্থা

ক্রমশই ব্যাপারটা নেশার মতো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

ক্রমশ কলকাতার সব হলই চেনা হয়ে যাচ্ছে, অনুভার দেখা হয়ে যাচ্ছে সব ছবি; ইংরিজি বাংলা। তবে অনুভার বাসা থেকে খুব দূরের পাড়ায় অথবা গোলমেলে পাড়ায় হলে, চিঠিতে থাকে, গড়িয়াহাট ব্রিজের ডানদিকে অপেক্ষা কোরো, এ হলটা খুঁজে বার করা তোমার পক্ষে শক্ত। গড়িয়াহাট ব্রিজটা অনুভাদের বাসার নিতান্ত নিকটে। নতুন কোনও ছবির সন্ধান না পেলে মাঝে মাঝে উত্তর কলকাতায় চলে যায় থিয়েটারে। ঐ অঞ্চলে চেনা-জানা কেউ তেমন নেই বলে বেশ নিশ্চিন্তেই বসে। দামি সিটে বসে। অমলেশের এখন চাকরিতে অনেক উন্নতি হয়েছে।

প্রথম প্রথম ফেরবার সময় অমলেশ খানিকটা পথ একসঙ্গে এসে কোনও একখানে ছেড়ে দিত। অনুভাকে এখন প্রায়ই দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়। অবশ্য বাড়ির মধ্যে ঢোকে না কোনওদিনই। এখন অমলেশ কোম্পানি থেকে একটা ছোট গাড়ি পেয়েছে নিজের ব্যবহারের জন্যে। অফিস ফেরত নিজস্ব জগতের পর্ব সেরে রাত করে বাড়ি ফেরাই ওর রীতি। ড্রাইভার নেয়নি, নিজেই চালায়, অতএব ওর গতিবিধির খবর ওর নিজেরই হাতে। কিন্তু আজ?

আজ আপনাকে দেখে তাড়াতাড়ি পালাল—' একটু হাসির মতো করে বলল, অনুভা। যেন কোনও ছোট ছেলের দুষ্টুমির কথা বলল কৌতুকের ভঙ্গিতে। আমি ওর মুখটা কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলাম না, ওর ঘাড়টা জানালার দিকে ঘোরানো ছিল।

আমি ওর সেই অলঙ্কারবিহীন ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, কিন্তু এখন, আর এর মূল্যই বা কী, মানেই বা কী? অনুভা হঠাৎ খুব হালকা গলায় বলে উঠল, 'মানেও কিছু নেই, মূল্যও কিছু নেই, এখন!

মাঝে মাঝে এক একটা সন্ধে একটু ভালো কাটে। এই আর কি।'

এখন আমি অনুভার মুখটা দেখতে পেলাম না।


আশা করি আজকের এই ব্লগে শেয়ার করা আশাপূর্ণা দেবীর ছোট গল্প হিসেবে অর্থহীন ছোট বাংলা গল্পটি আপনাদের ভালো লাগবে।। এরকম আরো নানা ধরনের বাংলা ছোটগল্প অনলাইনে পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটটি প্রতিদিন ভিজিট করতে পারেন।

tags: আশাপূর্ণা দেবীর ছোটগল্প - অর্থহীন || Bangla Short Stories | bangla golpo | বাংলা ছোট গল্প | বাংলা ছোট গল্প সমগ্র | Bengali short stories 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top