ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো |
ভারতীয় সংবিধানের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো || একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্ন উওর 2023
ভূমিকাঃ 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারতকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য বা সঠিক শাসনব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য 1966 সালের 9 ডিসেম্বর গঠিত হওয়া গণপরিষদ তিন বছর ধরে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর 1949 সালের 26 শে নভেম্বর ভারতের সংবিধান গ্রহন করে 1950 সালের 26 জানুয়ারি তা কার্যকর করে। 1950 সালের 26 জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া ভারতের এই সংবিধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ মোটেও সহজ নয়। তবে বিভিন্ন মতবিরোধের পর ভারতের সংবিধানকে প্রকৃতিগত দিকথেকে তিন ভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যথা- ভারতীয় সংবিধানের আকারগত দিক, সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতিগত দিক এবং শ্রেণিচরিত্রগত দিক।
ভারতীয় সংবিধানের আকারগত দিকঃ-
ভারতের সংবিধান হল বিশ্বের বৃহত্তম সংবিধান। এই সংবিধানের মতো বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সংবিধানে এত বেশি ধারা, উপধারা, তপশিল প্রভৃতি নেই। মূল সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা ছাড়াও ৩৯৫টি ধারা (Article), বহু উপধারা (Clause) এবং ৮টি তপশিল (Schedule) ছিল। পরবর্তী সময়ে বার বার সংবিধান সংশোধিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন অংশ (Part), ধারা, উপধারা ও তপশিল যেমন সংবিধানের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে, তেমনি কিছু কিছু ধারা, উপধারা ইত্যাদির বিলোপসাধনও করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মূল সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য কিংবা ট্রাইবিউনাল সম্পর্কে কোনো কিছু বলা না-হলেও ১৯৭৬ সালে ৪২-তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংযোজিত ৪-ক এবং ১৪-ক অংশে (Part IVA & IXVA) যথাক্রমে নাগরিকদের কর্তব্য এবং ট্রাইবিউনাল সম্পর্কিত ব্যবস্থাদি লিপিবদ্ধ করা হয়। অনুরূপভাবে, ১৯৫১ সালে প্রথম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নবম তপশিল যুক্ত হওয়ার ফলে তপশিলগুলির সংখ্যা ৮ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯-এ দাঁড়ায়। এইভাবে সংবিধান সংশোধনের ফলে বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের কার্যত প্রায় ৪৬০টি ধারা, বহু উপধারা এবং ১২টি তপশিল রয়েছে। বলা বাহুল্য, আকৃতিগতভাবে বৃহৎ হওয়ার ফলে প্রকৃতিগতভাবেও সংবিধানটি বিশেষ জটিল হয়ে পড়েছে।
সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতিগত দিকঃ-
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের সংশােধন পদ্ধতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। ভারতীয় সংবিধান যাতে গতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে জাতীয় স্বার্থ ও প্রয়ােজন পূরণের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায় সে ব্যাপারে সংবিধান প্রণেতারা সজাগ ছিলেন।
ভারতের সংবিধানের বিংশতি অধ্যায়ে ৩৬৮ নং ধারায় সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে-
সরল পদ্ধতিঃ- সংবিধানের অন্তর্গত কতকগুলি বিষয়ের পরিবর্তন বা সংশােধন অত্যন্ত সরল প্রকৃতির। সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে সংবিধান সংশােধন করা হয়। এজন্য কোনাে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়ােজন হয় না। যেসব বিষয় এই পদ্ধতির অধীনে সংশােধন করা যায় তার মধ্যে রয়েছে, নতুন রাজ্যের সৃষ্টি বা পুরােনাে রাজ্যের সীমানা বা নাম পরিবর্তন, নাগরিকতা, বিধান পরিষদ সৃষ্টি বা বিলােপসাধন, সংসদ সদস্যের বিশেষ অধিকার এবং বেতন ও ভাতা, সরকারি ভাষা, দেশের নির্বাচন, সুপ্রিমকোর্টের এলাকা সম্প্রসারণ প্রভৃতি।
আংশিক জটিল পদ্ধতিঃ-
৩৬৮ নং ধারায় উল্লিখিত সংবিধান সংশােধনের এই পদ্ধতি অনুযায়ী সংবিধানের কিছু নির্দিষ্ট অংশের সংশােধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মােট সদস্যের অর্ধেকের বেশি এবং উপস্থিত ও ভােটদানকারী সদস্যের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়ােজন হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সংবিধানের তৃতীয় ও চতুর্থ অংশের যথাক্রমে মৌলিক অধিকার ও নির্দেশাত্মক নীতিসমূহের ধারাগুলির পরিবর্তন করা যায়।
জটিল পদ্ধতিঃ-
সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারায় জটিল পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী প্রথমে সংশােধনী প্রস্তাবটিকে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মােট সদস্যদের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভােটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ কর্তৃক সমর্থিত হতে হবে। এরপর প্রস্তাবটিকে রাজ্য আইনসভাগুলির অনুমােদনের জন্য পাঠানাে হয়। এক্ষেত্রে অন্তত অর্ধেক রাজ্য আইনসভার অনুমােদন পাওয়া গেলে প্রস্তাবটিকে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে সমস্ত বিষয় এই পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত তাদের মধ্যে রয়েছে, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার বন্টন, কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতার পরিধি, সুপ্রিমকোর্ট এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও রাজ্যগুলির হাইকোর্ট-সংক্রান্ত বিষয়, সংবিধান সংশােধন পদ্ধতি ইত্যাদি সংশোধিত হতে পারে।
সংবিধানের শ্রেণিচরিত্রগত দিকঃ
ভারত তত্ত্বগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র হলেও কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে যেভাবে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়েছে, তাতে কার্যত সর্বক্ষেত্রে কেন্দ্রের অপ্রতিহত প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া, রাষ্ট্রপতির হাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা প্রদান; রাজ্যপালের হাতে 'স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা' ('discretionary power) অর্পণ; রাজ্যের নাম, সীমানা প্রভৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে প্রদান; গুরুত্বপূর্ণ কর (tax) আরোপ ও আদায়ের দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে অর্পণ প্রভৃতির মাধ্যমে ভারতীয় বুর্জোয়া-জমিদার শ্রেণি ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন নীতিকে আইনগত রূপ দিয়ে সংবিধানকে নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে ব্যবহার করছে। ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অংশে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের একটি বিশাল তালিকা সন্নিবিষ্ট হলেও কাজের অধিকার, বার্ধক্য ও বেকার অবস্থায় ভাতা পাওয়ার অধিকার প্রভৃতি স্বীকৃতি লাভ করেনি। “সবুজ বিপ্লব', 'গরিবী হঠাও', 'বিশদফা কর্মসূচি' প্রভৃতির মাধ্যমে কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণই সাধিত হয়নি। এইসব কর্মসূচির মাধ্যমে ধনীরা অধিকতর ধনী হয়েছে এবং দরিদ্ররা অধিকতর দরিদ্র হয়ে পড়েছে। কাম্য ভূমিসংস্কার কর্মসূচির অভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বুর্জোয়া-জমিদারশাসিত সমাজে ধনবৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের জাতপাত ব্যবস্থা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রাধান্য, আঞ্চলিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রভৃতি আসর জমিয়ে বসেছে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষ আর শাসকশ্রেণির কাছ থেকে ভালো কিছু পাওয়ার আশা ত্যাগ করেছে। সুতরাং বলা যায়, ভারতীয় সংবিধান প্রকৃতিগতভাবে বুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় তা জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হয়েছে বলে বামপন্থী সমালোচক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন।