আজকের এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাস এবং স্নাতক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় 'প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো' এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেছনে কী কী কারণ ছিল সেই বিষয়টা সম্পর্কে আলোচনা করে এই বিষয়ে তোমাদের ধারণা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করবো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো। || নবম শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তর
ভূমিকাঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর আগে যুদ্ধ ঘটেছিল। কিন্তু ১৯১৪-১৯ সাল পর্যন্ত এই বিশ্বযুদ্ধ ছিল অভূতপূর্ব। যুদ্ধের এত ব্যাপক প্রসার আর কোথাও দেখা যায়নি। ১৯০৭ সাল নাগদ সারা বিশ্বে দুটি সামরিক শিবির সৃষ্টি হয়। একটি ত্রি-মৈত্রীর সংস্থা এবং অপরটি ত্রিশক্তির আঁতাত, প্রথমটিতে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া এবং দ্বিতীয় জোটে ছিল জাপান, জার্মানি, তুরস্ক, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি। জার্মানী ছিল প্রধান শত্রু। তার আগ্রাসী নীতিকে যে কোনভাবেই হোক না কেন প্রতিহত করতে হবে। তারপর সার্বিয়াতে অস্ট্রিয়ার ডিউককে হত্যা বিশ্বযুদ্ধকে ডেকে এনেছিল। অনেকে প্রথম মহাযুদ্ধের জন্য জার্মানীকে এককভাবে দায়ী করেছিল। আসলে প্রথম মহাযুদ্ধ ছিল সমষ্টিগত কারণের ফলশ্রুতি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেছনে একাধিক কারণ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটার পেছনে একাধিক বিষয়ে কাজ করেছিল এবং সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমেই আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ সম্পর্কে জানতে পারি। যেমন-
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদঃ বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য সাম্রাজ্যবাদ কতটা দায়ী ছিল?
বিভিন্ন ঐতিহাসিক, রাজনীতিবিদ, সমাজ চিন্তাবিদ, যেমন জবসন, লেলিন প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করেছেন।তাদের মতে পাশ্চাত্যের দেশগুলো যেমন ব্রিটেন,জার্মানি,ফ্রান্স ইত্যাদিতে শিল্প বিপ্লবের ফলে এই সমস্ত দেশ গুলি বা রাষ্ট্রগুলির আর্থিক ব্যবস্থা খুবই মজবুত হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর মূলধনের প্রাচুর্য থাকায় তারা সাম্রাজ্য গ্রাসের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলি আরো নতুন নতুন দেশে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী হয়ে পড়েছিল এবং নতুন নতুন দেশ-বিদেশে নিজেদের বাজার দখল করতে চাওয়া, সেখান থেকে কাঁচামাল সরবরাহ, বাণিজ্যিক পণ্য সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়গুলি সৃষ্টি করেছিল। এবং এছাড়াও বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি সাম্রাজ্যবাদ নীতি গ্রহণ করেছিল।। এবং এই সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ থেকেই বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে ত্রিশক্তি ও ত্রিপল আতাত গঠনঃ
রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হন। জার্মানির ঐক্য স্থাপনের পর বিসমার্ক জার্মানিকে পরিতৃপ্ত দেশ বলে বর্ণনা করেছিলেন এবং এরপর তিনি ফ্রান্সকে এক ঘরে রাখার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি অস্ট্রিয়া, ইতালি এবং জার্মানিকে নিয়ে ত্রিশক্তি মৈত্রী গঠন করেছিলেন। বিসমার্কের এই কার্যকলাপের পর অপরদিকে ব্রিটেনের নেতৃত্বে 1907 সালের মধ্যেই ব্রিটেন- ফ্রান্স ও রাশিয়াকে নিয়ে ত্রিপল আঁতাত গঠন করে। এরফলে ইউরোপ দুটি শক্তিশালী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে জার্মানি,অস্ট্রিয়া এবং ইতালি এবং অন্যদিকে ছিল ফ্রান্স ব্রিটেন এবং রাশিয়া। এবং এই দুটি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিনের পর দিন বেড়েই চলে. এবং এই ত্রিশক্তি মৈত্রী ও ত্রিশক্তি আঁতাত এর প্রতিদ্বন্দ্বিতাই শেষ পর্যন্ত মহাযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল।।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে ইংল্যান্ড ও জার্মানীর মধ্যে নৌ-প্রতিদ্বন্দ্বীতাঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৃতীয় কারণ হিসেবে জার্মানী ও ব্রিটেনের মধ্যে ঔপনিবেশিক, বাণিজ্যিক এবং নৌশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে অনেকে দায়ী করেছেন। বিসমার্ক জার্মানীকে ১৮৭০ সালের পর ইউরোপের মধ্যেই সীমিত রেখেছিলেন। ব্রিটেনও রাশিয়াকে সন্তুষ্ট রেখেছিলেন। কিন্তু কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম বিসমার্ককে সরিয়ে দেন। ইতিহাসে এই ঘটনা পাইলটের পতন নামে পরিচিত। উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্স অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল।
ব্রিটেন ও ফ্রান্স এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। জার্মানী এ ব্যাপারে ছিল অনেক পিছিয়ে। দ্বিতীয় কাইজার উইলিয়াম ব্রিটেনে ও ফ্রান্সের সঙ্গে উপনিবেশিক ও নৌবাহিনী সম্প্রসারণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। তিনি বার্লিন, বাগদাদ রেলপথ নির্মাণ, দক্ষিণ আফ্রিকাতে বুয়রদের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সমর্থন, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মরক্কো বন্দরে জার্মান নৌ জাহাজ প্রেরণ করেছিলেন।
জার্মানী চীনের কোন কোন অঞ্চলে যেমন— কি-আও-চাও, উহা-হা-উই প্রভৃতি অঞ্চল দখল করেছিল। জার্মানীর কাইজার উইলিয়াম ঘোষণা করেছিলেন যে জার্মানীর ভবিষ্যত জলেই নিহিত। অর্থাৎ তিনি ব্রিটেনের এ ব্যাপারে একচ্ছত্র আধিপত্য ভাঙতে চেয়েছিলেন। ব্রিটেনের নৌবহর সংক্রান্ত মন্ত্রী এ ব্যাপারে জার্মানীকে বিরত হতে বলেন। কারণ তাঁর মতে এই কাজ জার্মানীর পক্ষে অপরিহার্য তো নয়ই বরঞ্চ অমিতব্যায়িতার পরিচমা। ১৮৯৯ সালে আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন হেগে অনুষ্ঠিত হয়। অস্ত্র নির্মাণ নিয়ে একদিকে জার্মানী ও অপরদিকে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীতার সৃষ্টি হয়। এরূপ প্রতিযোগিতা বিশ্বশক্তির পক্ষে মোটেই অনুকূল ছিল না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে দ্বিতীয় উইলিয়ামের সাথে ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে শত্রুতাঃ
আলসাস ও লোরেন অঞ্চলকে ঘিরে জার্মানী ও ফ্রান্সের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ও পারস্পরিক শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছিল। এই অঞ্চল দুটি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। ১৮৭০ সালে ফ্রান্সকে সেডানের যুদ্ধে পরাজিত করে জার্মানী এ অঞ্চল দুটিকে অধিকার করে নিয়েছিল। ১৮৯৪ সালে এ ব্যাপারে ফ্লাদ রাশিয়ার সাহায্য লাভের জন্য রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। তারপর বলকান অঞ্চলে জার্মানী অস্ট্রিয়াকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের এটি ছিল আগ্রাসী নীতির অন্যতম সৃষ্টি। এর ফলে রাশিয়া ও জার্মানীর মধ্যে আরও বেশী তিক্ততার সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের দিকে পরিস্থিতি নিয়ে যায়। সবশেষে প্রথম মহাযুদ্ধের জন্য সার্বিয়ার ঘটনাকে দায়ী করা হয়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে ফ্রান্সিস ডিউক এবং সোফিয়ার মৃত্যুঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে প্রাণ সৃষ্টি এবং সোফিয়ার মৃত্যু ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মূলত এই ঘটনার পরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণদামাদা। বেজে উঠেছিল। ১৯১২-১৩ সালে অস্ট্রিয়া নিকট প্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ১৮৭৮ সালের নিকট প্রাচ্যের সমস্যা সমাধান করতে পারেনি। বলকান জাতীয়তাবাদ ক্রমশঃ উৎরূপ ধারণ করেছিল। অস্ট্রিয়া, বসনিয়া এবং হার্জিগোভিনা অধিকার করেছিল। ফলে সার্বিয়ার জাতীয়তাবাদ আন্দোলন ব্যাহত ও অপমানিত হয়েছিল। আর ছিল সার্বিয়ার সঙ্গে বুলগেরিয়ার বিবাদ। এরূপ জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ১৯১৪ সালে জুলাই মাসে সেরাজেভোতে কয়েকজন উগ্রপন্থী অস্ট্রিয়ার ডিউক ফ্রান্সিস এবং তার স্ত্রী সোফিয়াকে হত্যা করেছিল। অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার কাছে চরম পত্র পাঠাবার পর সার্বিয়া অস্ট্রিয়ার দাবী মানতে রাজী ছিল না। সুতরাং এই ঘটনার পরই ২৮শে জুলাই অস্ট্রিয়া সার্বিয়া আক্রমণ করেছিল। জার্মানী, বেলজিয়াম ও ফরাসী সীমান্ত আক্রমণ করার পরই প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
উপসংহার,
আসল কথা, প্রথম মহাযুদ্ধ কোন হঠাৎ বা আকস্মিক ঘটনা ছিল না, সম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বিভিন্ন শক্তিবর্গের নিজেদের মধ্যে সমঝোতার অভাবে এই যুদ্ধ ঘটেছিল। জার্মানী বিশেষ করে কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের মহাযুদ্ধে প্রবেশ করার মতলব বা পরিকল্পনা ছিল না। ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের বৈরী মনোভাবও দায়ী ছিল। সুতরাং ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল সামগ্রিক ও বিভিন্ন কারণের সমষ্টিগত ফল। ১৯০৭ সালের পর সমগ্র বিশ্ব দুটি সশস্ত্র সামরিক শিবিরে ভাগ হয়ে পড়েছিল। বিসমার্কের মত দক্ষ নেতার অভাব ছিল। কাজেই স্বাভাবিক পরিণতিতেই মহাযুদ্ধ এসেছিল।আশা করি আজকের এই ব্লগ পোষ্ট থেকে তোমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেছনে কী কারণ ছিল তা জানতে পেরেছো এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ সম্পর্কে তোমাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই।।