আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। ওই অভিযানের ফলাফল আলোচনা কর।

0

আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। ওই অভিযানের ফলাফল আলোচনা কর।

আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। ওই অভিযানের ফলাফল আলোচনা কর।


উঃ-

ভূমিকাঃ যবন বা ইন্দো-ব্যাকটিয় গ্রীক :- সাধারণত ভারত ইতিহাসে বিদেশী জাতিকেই ‘যবন’ বা ‘ম্লেচ্ছ' নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই 'যবন' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল 'আইয়োন’ বা ‘আইয়নীয়' শব্দ থেকে। প্রাচীন গ্রীস দেশে যে বিশেষ এক জাতীর কথা উল্লিখিত আছে, তার নাম ছিল -- ‘আইওনীয়’। পারস্যদেশে এই শব্দটির ‘যোন’ শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হত। ‘যোন’ বলতে গ্রীসদের কথাই স্মরণীয় হয়ে ওঠে। ভারতে এই ‘যোন’ শব্দটি যবন শব্দে পরিণত হয়েছে।


মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা যখন অস্তাচলগামী, ঠিক তখনই হিন্দুকুশ পর্বতের চূড়া অতিক্রম করে ব্যাকট্রিয় নামক অঞ্চল থেকে গ্রীসরা ভারতবর্ষে ঢুকে পড়েছিল। ভারতবর্ষে ঢোকার মুহূর্তেই তারা ‘বাহ্ণিক যবন' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ব্যাকট্রিয়া নামক অঞ্চলটি ভারত ইতিহাসে বালথ্ বা বাহ্লিক দেশ নামে পরিচিত হয়েছিল। বালখ্ বা ব্যাকট্রিয়া নামক অঞ্চল থেকে আগত অধিবাসীগণ ‘ব্যাকট্রিয় গ্রীক’ বা ‘ইন্দো গ্রীক’ নামেও পরিচিত হয়। ব্যাকট্রিয়া থেকে ভারতবর্ষের মাটিতে বসবাস করতে আসার ফলে এদের ইন্দো-গ্রীক বলা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, এই ব্যাকট্রিয় গ্রীকরা কখনই গ্রীস দেশ থেকে আসেনি।

ভারত আক্রমণঃ  


অ্যান্টিওকাস ব্যাকট্রিয়দের সাহায্য নিয়ে ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিলেন। তাঁর অভিযানকালে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যিনি শাসনকর্তা ছিলেন তার নাম সুভগৃসেন। তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতা লাভের আকাংখায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে অ্যান্টিওকাসের অতর্কিত আক্রমণে তিনি আতংকিত এবং বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। অ্যান্টিওকাস তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং অসংখ্য রণহস্তী লাভ করেন।

এরপর অ্যান্টিওকাস সিরিয়ায় ফিরে যান। ব্যাকট্রিয়াগণ অ্যান্টিওকাসের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সীমান্ত অঞ্চলগুলি সম্পর্কে অবগত হন। তাঁরা ভারত সীমান্তে অনুপ্রবেশ করার একটি পরিকল্পনাও গ্রহণ করেন।

ডিমিট্রিয়াস ও মিনান্দারঃ 


ইউথিডেমসের পুত্র ডিমিট্রিয়াসের রাজত্বকালেই ব্যাকট্রিয়গণ ভারতবর্ষের মাটিতে প্রকৃত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন এবং শক-পার্থীয় কুষাণ শক্তির উদ্ভবের মধ্যবর্তী সময়ে ইন্দো গ্রীক শক্তির আগমন বা উদ্ভব ঘটে। ডিমিট্রিয়াসের পরবর্তীকালে ইউক্র্যাটিডিস ভারতবর্ষে অভিযান শুরু করেন এবং তাঁর পরবর্তীকালে মিনান্দার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের মধ্যে মিনান্দারই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। যিনি আলেকজাণ্ডার অপেক্ষা বেশী রাজ্য জয় করেছিলেন। ঐতিহাসিক স্ট্র্যাবো মনে করেন তাঁর সাম্রাজ্য কাবুল থেকে | মথুরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।

আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানঃ


আমরা জানি খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে পদার্পণ করেন। তিনি যখন সিন্ধুনদ অতিক্রম করেন, ঠিক তখনই তাঁর আগমনের সংবাদে ভীত হয়ে তক্ষশিলার রাজা নিজেকে নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে এই গ্রীক বীরের কাছে বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করেন এবং আলেকজান্ডারকে প্রচুর উপহারসহ ভারতের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে সহায়তা করেন। এরপর আলেকজান্ডার আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ঝিলাম নদীর তীরে তীর্ণ হন এবং এর পূর্বতীরে অবস্থিত পুরুর রাজ্যটি আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে আক্রান্ত হয়ে পুরু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। এবং আলেকজান্ডারের হাতে বন্দী হন। তবে পুরুর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার তাঁর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। তিনি পুরুকে অপহৃত রাজ্যটি ফিরিয়ে দেন। বিজয়ের নিদর্শন হিসাবে অবশ্য আলেকজান্ডার ঝিলাম নদীতীরে দুটি নগরের প্রতিষ্ঠা করেন।


পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার বিখ্যাত রাভী নদীর নিকটবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত উপজাতীয় প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলিকে আক্রমণ করে এদের বশ্যতা লাভ করেন। এরপর আলেকজান্ডারের সৈন্যদল বিপাশা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। কিন্তু সেখানেই এই গ্রীক বীরের ভারত আক্রমণের পরিসমাপ্তি ঘটে। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার সময়ে অবশ্য আলেকজান্ডারকে বেশ কয়েকটি

উপজাতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। অবশ্য গ্রীক সৈন্যদল তাদের প্রতিরোধ চূর্ণ করে দেয়। পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার ব্যাবিলনের পথে অগ্রসর হন। সেখানেই ৩২৩ খ্রিঃ পূর্বাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের 

প্রভাবঃ 


বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্মিথ মনে করেন, আলেকজান্ডারের অভিযান ভারত ইতিহাসের উপর প্রত্যক্ষভাবে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। ভারতবাসীর জীবনধারার উপরও তেমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। একথা ঠিক যে, ভারতের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক রীতিনীতির উপর গ্রীক প্রভাব সেভাবে প্রভাবিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানটি ছিল শুধুমাত্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সীমাবদ্ধ। বৃহত্তর ভারতে, বিশেষ করে ভারতের মধ্যপ্রদেশে আলেকজান্ডার সেভাবে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং শুধুমাত্র যুদ্ধের ভয়াবহতা ছাড়া এই অভিযানের তেমন কোনো সাফল্য ভারতে দেখা যায়নি।


তবে একথা সত্য যে, আলেকজান্ডারের এই অভিযানের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে গভীর আদান-প্রদানের পথ প্রস্তুত হয়েছিল। এর ফলে ভারতের সঙ্গে ইউরোপের ব্যবসা-বানিজ্য ও ভাব বিনিময় বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হয়। ভারতীয় সভ্যতা এবং শিল্প ও গ্রীক-রোমান শিল্পের সমন্বয় সাধন এর ফলে সম্ভব হয়েছিল। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, গান্ধার শিল্পের উত্থান ও গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রভাব এই যুদ্ধের ফলে সাধিত হয়েছিল। এছাড়া এই সময় থেকেই মুদ্রার ক্ষেত্রে ভারতীয়রা গ্রীক মুদ্রার অনুকরণ করতে শুরু করে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top