দশম শ্রেণির ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উওর | সংস্কার বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা বড় প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নঃ উনিশ শতকের বাংলায় নবজাগরণের চরিত্র, প্রকৃতি ও বিতর্ক সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা,
নবজাগরণের সংজ্ঞা দাও এবং নবজাগরণের চরিত্র প্রকৃতি ও বিতর্ক সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ রেনেসাঁস একটি ফরাসি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হল নবজাগরণ। রেনেসাঁস শব্দটি ইউরোপে বিশেষত ইটালির ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এই শব্দের দ্বারা মূলত ১৪-১৬ শতকের ইতালীয় সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও রাজনীতির ক্ষেত্রে যে অগ্রবর্তী দেখা দিয়েছিল, তা মূলত হলো ইউরোপের নবজাগরণ।
উনিশ শতকে বাংলা তথা বিশেষ করে কলকাতায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে এক যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আলোড়নের সূচনা হয়েছিল। এই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজে ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি - জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে কলকাতা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অগ্রবর্তী দেখা দিয়েছিল, তাকেই ঐতিহাসিকরা 'বঙ্গীয় নবজাগরণ' বা 'Bengal Renaissance' বলে অভিহিত করেছেন।
বাংলার নবজাগরণের স্রষ্টাঃ
উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, সে নবজাগরণের প্রকৃতি স্রষ্টা কারা অথবা কাদের মাধ্যমে এই নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, সেউ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু মনে করা হয় যে- রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, ডিরোজিও, স্বামী বিবেকানন্দ, উইলিয়াম জোন্স, জোনাথন ডানকান এবং কোলব্রুকের মত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টাতেই বাংলায় নবজাগরণ ঘটেছিল । এছাড়াও, বাংলার নবজাগরণের ক্ষেত্রদ এশিয়াটিক সোসাইটি, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানও বিশেষ ভূমিকা ছিল।
বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতিঃ
উনিশ বাংলায় কলকাতার সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে যে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল বা নবজাগরণ ছিল, সেই নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি কিরূপ ছিল সেউ নিয়ে পন্ডিত মহলে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বিভিন্ন পন্ডিত নিজেদের মতো করে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। যেমন-
উনিশ শতকের বাংলার বৌদ্ধিক অগ্রগতিকে নবজাগরণ বলার স্বপক্ষে থাকা কয়েকজন:-
• ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তার 'History Of Bengal' গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলাকে নবজাগরণের পীঠস্থান' বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন যে, ব্রিটিশ শাসনে সবচেয়ে বড় অবদান হল বাংলার নবজাগরণ যা ব্যাপ্তি ও গভীরতার দিয়ে ইউরোপের রেনেসাঁসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।।
• অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেছেন যে, বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসনে বুর্জোয়া অর্থনীতি ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়। তার ফলে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে তাকে সাধারণভাবে নবজাগরণ বলা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় নবজাগরনের সেই ভূমিকা পালন করেছিল বাংলা (তৎকালীন বাংলাদেশ)।
বাংলার নবজাগরণ প্রকৃত নবজাগরণ নয়ঃ
• অশোক মিত্র,বিনয় ঘোষ, সুপ্রকাশ রায় ডক্টর বরুন দেন ডক্টর সুমিত সরকার প্রমুখ উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে যে বৌদ্ধিক অগ্রগতি ঘটেছিল, সেই বৌদ্ধিক অগ্রগতিকে তারা বাংলার নবজাগরণ বলে স্বীকার করেন না।।
• ডক্টর বিনোদ ঘোষের মতে বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রবঞ্চনা মাত্র।
• ডক্টর সুপ্রকাশ রায় লিখেছিলেন যে বাংলার নবজাগরণ আন্দোলন ইউরোপের নবজাগরণ আন্দোলনের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী ছিল।।
• অরবিন্দ পোদ্দার এর মতে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল 'একটি বিকৃত ও নীরস নবজাগরণ'।
তথাকথিত নবজাগরণঃ সেন্সার কমিশনার অশোক মিত্র ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তার Census Report এর সময় বাংলায় উনিশ শতকের জাগরণকে 'তথাকথিত নবজাগরণ' (so called Renaissance) বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে নয়া জমিদারশ্রেণি সাধারণ রায়তদের শোষণ করে যে বিপুল অর্থ লাভ করেছিল তার একটা বিরাট অংশ তারা কলকাতার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যয় করেছিলেন। এই কর্মকান্ডের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও যোগ ছিল না।