চার্বাকদের জড়বাদের সমালোচনা সম্পর্কে আলোচনাঃ
ভূমিকাঃ ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক মনোভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে চার্বাকরা কোনো অধিবিদ্যা সংক্রান্ত মতবাদ আলোচনা না করে তাঁরা জড়বাদকেই প্রচার করেছেন। কিন্তু চার্বাকদের জড়বাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় গুলো তাদের বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। যেমন-
(i) চার্বাক জড়বাদ চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ। চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু আমাদের জ্ঞান কেবল প্রত্যক্ষের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বস্তুত প্রত্যক্ষই যদি একমাত্র প্রমাণ না হয়, তাহলে চার্বাক জড়বাদ স্বীকার করার পক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
(ii) দার্শনিক মতবাদ হিসেবে জড়বাদ গ্রহণযোগ্য মতবাদ নয়। জড়বাদ অনুযায়ী জড়ই পরম সত্তা এবং এই জগতের সবকিছুই জড়ের প্রকাশ। কিন্তু জড়বাদ প্রাণ ও মনের উৎপত্তির কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। বস্তুত জড় এবং জীবের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। জড়ের নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য নেই, কিন্তু জীবের আছে। জীবের মধ্যে যে উদ্দেশ্যমুখিনতা দেখা যায়, তাকে ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো চেতন সত্তার কারণতা স্বীকার করতে হয়। কাজেই জড়বাদের সৃষ্টি করেছে সাহায্যে জগতের সুসংহত রূপকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
(iii) চার্বাকদের স্বভাববাদও গ্রহণযোগ্য মতবাদ নয়। চার্বাকরা বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তিকেই ‘স্বভাব' নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু গণ্য করা যেতে বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। কাজেই চার্বাকরা পাশ্চাত্য দার্শী স্বভাব-নিয়মের উল্লেখ করতে গিয়ে তাঁদের প্রত্যক্ষবাদকে বিসর্জন পরমাণুবিদগণ দিয়েছেন।
(iv) চার্বাক মতে ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও মরুৎ—এই চারটি মহাভূত অভিযোগ উপ সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে পরস্পর মিলিত হয়ে জগতের উৎপত্তি যে, অনুমানের ঘটিয়েছে। কিন্তু চার্বাকদের এই আকস্মিকতাবাদ গ্রহণযোগ্য মতবাদ হতে পারে না। এই বৈচিত্র্যময় জগৎ হল একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংহত জগৎ। আকস্মিকতার দ্বারা কখনও এই জগতের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আকস্মিকতার দ্বারা জগতের ব্যাখ্যা দিতে গেলে একের পর এক আকস্মিকতা স্বীকার করতে হবে। ফলে সেক্ষেত্রে ‘অনবস্থা দোষ দেখা দেবে।
চার্বাকদের জড়বাদ সম্পর্কে নানা সমালোচনামূলক মন্তব্য করা হলেও, এটা স্বীকার করতে হয় যে,চার্বাক দর্শন যুক্তিবাদী দর্শন। যুক্তিনিষ্ঠ হওয়ার জন্যই চার্বাকরা একদিকে জড়বাদ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন এবং অপরদিকে আধ্যাত্মিক মনোভাবের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানাতে সক্ষম হয়েছেন। তাই অন্যান্য ভারতীয় দর্শনচিন্তার ক্ষেত্রে চার্বাক দর্শন নিন্দিত হলেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, উভয় দেশের দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে এই দর্শনের অবদান ও ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Tags :