কোল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো | প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উওর
আজকের এই ব্লগের মাধ্যমে আমি তোমাদের সঙ্গে দশম শ্রেণির ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন,যেটা প্রায়শই মাধ্যমিকে এসে থাকে সেটা নিয়ে একটি নোট তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো। কোল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল প্রশ্নটি তোমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। তাই এই প্রশ্নটি তোমাদের খুব ভালো করে পড়া উচিৎ। ক্লাস টেনের ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর আমাদের ওয়েবসাইটে আগেও শেয়ার করা হয়েছে। আজকের পোস্টেও প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উওর হিসাবে " কোল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল " এর উওর শেয়ার করা হবে।
কোল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো | প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উওর
উওর : ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সরকারের শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে সমস্ত উপজাতীয় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোন বিদ্রোহ ছিল একটি উল্লেখযোগ্য উপজাতি বিদ্রোহ। কোলরা ছোটনাগপুর মালভূমি, সিংভূম প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করতো। কোলরা আবার হো, মুন্ডা, ওরাও প্রভৃতি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। 1831 খ্রিস্টাব্দের রাচি জেলায় ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের মাত্রা অনেক গুন বেড়ে যায়। যার ফলে কোলদের ওপর হওয়া হওয়া,ব্রিটিশ সরকারের নানা ধরনের শোষন,অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে 1831 খ্রিস্টাব্দে তারা " কোল বিদ্রোহ " শুরু করেছিল। এই বিদ্রোহের পেছনে তাদের নানা কারণ ছিল। যেমন -
কোল বিদ্রোহের কারণ -
◆ অন্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত : অন্যান্য উপজাতিদের মতো কোলরাও এটা মনে করতো যে,অরন্যের উপর তাদের চিরাচরিত অধিকার রয়েছে। আর তারা সেই চিরাচরিত অধিকার অনুযায়ী কোলরা অরণ্যেকে নিজেদের মতো করেই ব্যবহার করতো। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর কোলদের কাছ থেকে তাদের চিরাচরিত অরন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে কোলরা আগে যেভাবে অরণ্যেক নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতো, ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর কোলতা আর নিজেদের মতো করে অরণ্যেকে ব্যবহার করতে পারত না। যার ফলে কোলরা ব্রিটিশ শাষনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
◆ রাজস্ব বৃদ্ধি : ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার আগে কোলদের মধ্যে এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল যে, কোলরা অরণ্য থেকে জঙ্গল সাফ করে যেকোনো জমি উদ্ধার করে সেখানে তারা নিজেদের মতো করে চাষবাস বা কৃষি মকাজ করতে পারবে। এবং তার জন্য তাদের কোনো রকম খাজনা বা ট্যাক্স কাউকে দিতে হবে না।কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর এবং নতুন ভূমি রাজস্ব নীতির ফলে তাদের উদ্ধার করা জমির উপর সরকার ট্যাক্স বসায়। যার ফলে তাদের উদ্ধার করা জমিতে চাষ করার জন্য প্রতিবছর সরকারকে নগদ অর্থে খাজনা দিতে হতো। কিন্তু এই খাজনার পরিমাণ অনেক সময় এমন হয়ে যেত যে, কোলরা কিছুতেই সেউ খাজনার পরিমাণ মেটাতে পারতো না। যার ফলে কোলদের বিভিন্ন আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো।
◆ জমি হারানো : জমিতে চাষ করার জন্য কোলদের উপর যে খাজনা ধার্য করা হতো, কোলরা যদি কোনো কারণে সেই পরিমাণ খাজনা সরকারকে অথবা জমিদারদের দিতে না পারতো, তাহলে কোলদের কাছ থেকে তাদের নিজস্ব জমি অনেক সময় কেড়ে নেওয়া হতো। এবং এর তাদের বিরুদ্ধে তারা কোনো প্রতিবাদও করতে পারতো না। অথবা প্রতিবাদ করলেও তারা তাদের জমি ফিরে পেত না।
◆ ব্যবসায়ীদের শোষণ : ব্রিটিশ সরকার যখন নগদ অর্থের খাজনা প্রদানের নিয়ম চালু করায়, কোলরা সেই পরিমাণ খাজনা মেটানোর জন্য নিজেদের ফসল যখজ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে নগদ অর্থ আদায় করতে যেত,,তখন ব্যবসায়ীরা তাদের নানা ভাবে প্রতারিত করতো। ফলে কোলরা নিজেদের অনেক পরিমাণ ফল দিয়েও সেই পরিমাণ অর্থ লাভ করতে পারত না,,যে পরিমাণ অর্থ তাদের দরকার। সেই সময়কার বেশিরভাগ কোলরাই নিরক্ষর হওয়ার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের প্রাপ্ত অর্থের অনেক টাকাই কম দিত। কিন্তু তারা এই জিনিস গুলো বুঝতেই পারতো না।
◆ মহাজনদের শোষণ : আর্থিকভাবে শোষণ করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সেই সময়ে মহাজনরাও অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। মহাজনরা কোলদের নগদ ঋণ প্রদান করতো। কিন্তু সেই ঋনের বার্ষিক সুদের হার হতো খুবই বেশি। যার ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ঋনের পরিমাণ মতো কয়েক গুণ বেড়ে যেত। আর যখন সেই ঋণ শোধ করার সময় আসতো, তখন কোলরা কিছুতেই সেই ঋণের বোঝা কাটিয়ে উঠতে পারতোনা। যার ফলে কোলদের চরম আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। তখন এই আর্থিক অবস্থা কাটাতে কোলরা নিজেদের সর্বস্ব বিক্রি করে দিলেও,তারা কিছুতেই সেই ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো না।
◆ আফিম চাষে বাধ্য করা : কোল বিদ্রোহের আরো একটি অন্যতম কারণ হলো কোলদের আফিম চাষে বাধ্য করা। কোলদের একটি ঐতিহ্য বিরোধী কাজ হলো আফিম চাষ। যা তারা কিছুতেই করতে চাইত না। কিন্তু সেই সময় তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, আফিম চাষে বাধ্য করা হয়। যার ফলে কোলদের ঐতিহ্য আঘাত করা হয়। এবং এর ফলে কোলরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
◆ শারীরিক অত্যাচার : উপরিক্ত নানা কারণ ছাড়াও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্মাণ কারণ হলো কোলদের ওপর করা নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার। জমিদার, ইংরেজ কর্মচারী এবং বহিরাগত ব্যবসায়ী, মহাজনরা কোলদের ওপর নানা কারণে শারীরিক অত্যাচার করতো। কোন উপজাতির পুরুষের পাশাপাশি কোল রমনী বা মেয়েদের ওপরেও নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করা হতো।
উপসংহার : উপরিক্ত নানা কারণ ছাড়াও আরো অন্য কিছু কারন যেমন- বিভিন্ন ধরনের কর, উপকর, সরকারের করের উপর আরও অতিরিক্ত কিছু কর এবং অন্যান্য নানা অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোলরা 1831 খ্রিস্টাব্দের বুদ্ধ ভগত,জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা প্রমুখের নেতৃত্বে জমিদার,ব্রিটিশ সরকার ও মহাজনদের নানা শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে " কোল বিদ্রোহ " শুরু করেছিল।
কোল বিদ্রোহের গুরুত্ব বা ফলাফল
ভূমিকা ; 1831 খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধ ভগত,জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা প্রমুখের নেতৃত্বে কোল বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করলেও, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে কোলরা হার মানতে বাধ্য হয়। বিদ্রোহের প্রধান নেতাদের মৃত্যুর মাধ্যমে কোল বিদ্রোহ সমাপ্ত হয়ে গেলেও,কোল বিদ্রোহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল দেখা গিয়েছিল। যেমন-
◆ দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি গঠন : কোল বিদ্রোহের পর সরকার কোলদের পৃথক একটি ভূখণ্ড গঠনের ব্যাপারটি বুঝতে পারে। এবং সেই কারণে 1834 খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কোলদের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামক একটি পৃথক ভূখণ্ড গঠন করে।
◆ জমি ফেরত : কোল বিদ্রোহের একটি অন্যতম কারণ ছিল কোলদের নিজস্ব জমি কেড়ে নেওয়া। কিন্তু কোল বিদ্রোহের পর সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোলদের কাছে থেকে যে সমস্ত জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে সেগুলো তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে।।
এবং এই সিদ্ধান্তের হাত ধরেই ব্রিটিশ সরকার সরকারিভাবে কোলদের কিছু জমি ফিরিয়ে দেয়।।
◆ অসাধু ব্যবসায়ী ও মহাজনদের বিতাড়ন : ব্রিটিশ সরকার কোল বিদ্রোহের পর কোলঅধ্যুষিত এলাকায় বহিরাগত ব্যবসায়ী ও মহাজনদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। যার ফলে কোলরা বহিরাগত ব্যবসায়ী এবং মহাজনদের নানা ধরনের শোষণ এবং অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়।
◆ কোলদের নিজস্ব নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা : ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর কোলদের সমাজ জটিল ব্রিটিশ নিয়মকানুন প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু কোল বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার কোল সমাজ থেকে জটিল ব্রিটিশ নিয়মকানুন সরিয়ে নেয় এবং সেখানে কোলদের নিজস্ব ধর্মীয় বা সামাজিক নিয়মকানুন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
আশা করি আজকের এই আলোচনা থেকে তোমরা কোল বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছো। এবং 1831 খ্রিস্টাব্দের কোল বিদ্রোহের কারণ কি ছিল এবং কোন বিদ্রোহের ফলাফল অথবা কোল বিদ্রোহের গুরুত্ব সম্পর্কে তোমরা অনেকটা জেনে গেছো। যদি আজকের এই ব্লগ পোস্টটি তোমাদের ভালো লাগে,তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটের অন্যান্য ব্লগ পোষ্ট পড়ে দেখতে পারো।।
Tags :