ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক আলোচনা করো | বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ অধ্যায়ের বড়ো প্রশ্ন উত্তর

0


ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক আলোচনা করো | বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ অধ্যায়ের বড়ো প্রশ্ন উত্তর


ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক আলোচনা করো | বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ অধ্যায়ের বড়ো প্রশ্ন উত্তর

ভূমিকা : ভারতে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পর্তুগীজদের মাধ্যমে। 1556 খ্রিষ্টাব্দে গোয়ায় সর্বপ্রথম ভারতের প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু তখন সেরকম ভাবেও ছাপাখানার বিকাশ ঘটেনি। ভারত তথা বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ ঘটেছিল মূলত আঠারো শতকের শেষের দিকে এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে। সেসময় বিভিন্ন পর্তুগিজ যেমন জেমস অগাস্টাস হিকি 1777 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এবং 1778 খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিন্স চুচুড়ায় একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারীরা 1800 খ্রিস্টাব্দের আরো একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমস্ত ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারে সাহায্য করেছিল, তা আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারি। যেমন - 

শিশুশিক্ষার প্রসার : মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ সেই সময় শিশুশিক্ষার প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন, শিশুরা যদি প্রথমেই সঠিক ভাবে শিক্ষা না লাভ করে, তাহলে পরবর্তীকালে শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে তাদের নানা সমস্যা হবে। তাই মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামসুন্দর বসাক প্রমুখ শিশুশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে সেই সময় শিশুশিক্ষা ( মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত) বর্ণপরিচয় ( ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ), বাল্যশিক্ষা ( রামসুন্দর বসাক রচিত ) ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত বর্ণপরিচয় হলো এমন একটি গ্রন্থ, যেখানে তিনি শিশুদের বাংলা হরফ অথবা বর্ণ পরিচয় করিয়েছেন। এবং এই গ্রন্থটি ছিল শিশুদের বাংলা হরফ চেনা, বাংলা লিখতে শেখা, পড়তে শেখা ইত্যাদির ক্ষেত্রে একটি অন্যতম পাঠ্যপুস্তক।


বিভিন্ন বইপত্রের সহজপ্রাপ্তি : বিভিন্ন ছাপাখানা গুলি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বিভিন্ন শিক্ষামূলক গ্রন্থ অথবা ধর্মগ্রন্থ গুলি প্রাচীনকালের বিভিন্ন মুনি-ঋষিরা বা বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তিরা হাতে লিখতেন। যে সমস্ত শিক্ষামূলক গ্রন্থ নিজেরা তারা হাতে লিখতেন,তাতে তাদের প্রচুর সময় ব্যয় হতো এবং পরিশ্রম করতে হতো। যার ফলে সেই সময় খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বই পত্র লেখা সম্ভব ছিল না। যার ফলে বইপত্রের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু ছাপাখানা প্রসারের ফলে  ছাপাখানায় খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক বইপত্র বা পাঠ্যবই পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি ছাপানো যেত বা লেখা যেত। যার ফলে প্রাচীনকালে যে সমস্ত খুব অল্পসংখ্যক বই হাতে লেখা ছিল, পরবর্তীকালে ছাপাখানা বিকাশের মাধ্যমে সে বইগুলির বিভিন্ন কপি বের করা হয়। ফলে আগেকার দিনের সেই সমস্ত হাতে লেখা পুথির মধ্যে বা অল্প অল্প সংখ্যক বইয়ের মধ্যে যে সমস্ত জ্ঞান আটকে ছিল, তা ছাপাখানার ছাপার কালিতে বেরোনো অসংখ্য বই পত্রের মাধ্যমে সবার কাছে খুবই সহজ ভাবে অর্জন করার সুযোগ আসে। এবং সবার কাছে সেই সমস্ত বই সহ অন্যান্য আরও নানা ধরনের সহজলভ্য হয়ে ওঠে। এবং সবাই বইয়ের দোকান বা বাজার থেকে সেগুলো কিনে জ্ঞান লাভের সুযোগ পায়।


সস্তায় বই পত্র প্রাপ্তি : প্রাচীনকালে বিভিন্ন বইপত্র অথবা পুঁথিগুলো হাতে লেখা হতো বলে তার মূল্য ছিল খুবই বেশি। তাছাড়া সেই সমস্ত বইপত্রের সংখ্যাও ছিল খুবই কম। কারণ বর্তমান যুগের মতো সেই সময় একটি বইয়ের একাধিক কপি খুবই কম ছিল অথবা ছিল না বললেই চলে। সেই সমস্ত বইয়ের দাম বেশি হওয়ায় তখনকার সাধারণ অথবা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলে মেয়েরা সেই সমস্ত বই থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত না। যার ফলে তাদের জ্ঞান লাভের দরজা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধ থাকতো। কিন্তু ছাপাখানার প্রসারের ফলে একটি বইয়ের একাধিক কপি বের হওয়াও, সেই হাতে লেখা পুথিগুলির অনেক কপি অনেকের কাছে সহজলভ্য এবং সস্তা হয়ে ওঠে। ফলে সেই সমস্ত বইগুলো সাধারণত অথবা নিম্নোবিও ঘরের ছেলেমেয়েরাও  সেগুলো কিনে জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পায়। এবং এভাবে ধীরে ধীরে জ্ঞানের বিস্তার ঘটতে থাকে।

গন শিক্ষার প্রসার : সেই সময়ে ছাপাখানায় শুধুমাত্র যে বিভিন্ন স্কুল কলেজের পাঠ্য বা অপাঠ্য বই ছাপানো হতো তাই নয়। স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রী ছাড়াও সেসময় যারা স্কুল-কলেজে পাঠরত ছিল না?অর্থাৎ মাঝবয়সী বা বৃদ্ধ বয়সী মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের বইপত্র ছাপা হতো। সেই সময় ছাপাখানায় বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ, ধর্মকথা মূলক কাহিনীর বই ইত্যাদিও ছাপানো শুরু হয়। যার ফলে মানুষ নিজেদের এবং অন্যের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার সুযোগ পায়। 

পত্র পত্রিকার প্রকাশ : ছাপাখানার বিকাশে পরেই বিভিন্ন ধরনের পত্র-পত্রিকা বা সংবাদপত্র প্রকাশনা শুরু হয়। যার ফলে মানুষ দেশ-বিদেশের নানা খবরাখবর সম্পর্কে জানতে পারতো। এবং বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে পারতো। ফলে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বা শিক্ষার প্রসার ঘটে।


বিভিন্ন ধরনের বইয়ের সহজলভ্যতা : ছাপাখানার প্রসারের ফলে সে সময় বাজারে বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়।।যেমন ইতিহাস-ভূগোল,গণিত,জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা,বাংলা ব্যাকরণ,ইংরেজি ব্যাকরণ এবং অন্যান্য নানা ধরনের নানা বই বাজারে আসতে শুরু করে। যার ফলে বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের পছন্দমতো বই কিনে নিজের মতো করে জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পায়। ফলে ছাত্রছাত্রীদের একটি বৃহৎ অংশের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে।

বিভিন্ন উদ্যোগ : ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি , শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ - সে সময় বাংলায় বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যপুস্তক রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক রচনায় ভূমিকা পালন করেনি,তারা বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের খুবই অল্প দামে এবং অনেক সময় বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করার ব্যবস্থাও করেছিল। যাতে শিক্ষার্থীরা সেই পাঠ্য বই গুলি হাতে পেয়ে সহজে তাদের শিক্ষা অর্জন করতে পারে।।

উপসংহার, পরিশেষে বলা যায়, ছাপাখানার প্রসারের ফলে আগেকার দিনে বিভিন্ন পন্ডিত অথবা জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের হাতে লেখা পুথির যে সমস্ত জ্ঞান অল্পসংখ্যক কিছু বইয়ের মধ্যে আটকে ছিল, তা ছাপাখানা প্রসারের ফলে সেই সমস্ত বইয়ের মধ্যে অথবা হাতে লেখা পুথিত মধ্যে আটকে থাকা জ্ঞান অসংখ্য ছাপা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থী বা সমাজের সবার কাছে খুব সহজ ভাবে উঠে আসে। যার ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষার প্রসার ঘটে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top