উনিশ শতকের বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা আলোচনা করো| সমাজ সংস্কারে ব্রাহ্মসমাজের অবদান কী ছিল?
আজকে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস ( wb class 10 history ) দ্বিতীয় অধ্যায় " সংস্কার বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা " এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন " উনিশ শতকের বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা অথবা সমাজ সংস্কারে ব্রাহ্মসমাজের অবদান " এর উওর তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো। উনিশ শতকের বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা আলোচনা করো, - এই প্রশ্নটি তোমাদের মাধ্যমিক পরিক্ষায় 4 নম্বরের ( class 10 history question answer ) জন্য এসে থাকে। আজকের এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে তোমরা সমাজ সংস্কারে ব্রাহ্মসমাজের অবদান বা ভূমিকা কী ছিল তার একটি খুব সুন্দর ইতিহাস নোট ( wb class 10 history notes in Bengali ) এখান থেকে পেয়ে যাবে।
উনিশ শতকের বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা | সমাজ সংস্কারে ব্রাহ্মসমাজের অবদান
◆ সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন : রাজা রামমোহন রায় 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা বা 1830 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ গঠন করার পর, তিনি সেই সময়কার সমাজের একটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কুপ্রথা " সতীদাহ প্রথা " -র বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। যদিও এই সময়ে ব্রাহ্ম সমাজের সকল নেতারা সেরকমভাবেও এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে আসেননি, কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান রাজা রামমোহন রায় সমাজে প্রচলিত সেই ভয়ঙ্কর প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। রামমোহন রায় সেইসময়কার কিছু প্রগতিশীল চিন্তাধারা যুক্ত কিছু মানুষের সইস্বাক্ষর যুক্ত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে জমা দেন। এবং সেখানে তিনি সতীদাহ প্রথা বন্ধের দাবি জানান। সরকার রাজা রামমোহন রায়ের এই আবেদন মেনে নিয়ে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে 4 জ ডিসেম্বর 17 নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহ প্রথা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে। ব্রাহ্মসমাজের অথবা রাজা রামমোহন রায়ের এই আন্দোলনের ফলেই সেই সময় সমাজের একটি ভয়ঙ্কর কুপ্রথা বন্ধ হয়।
◆ সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট : তৎকালীন সময়ে ভারতে তথা বাংলার সমাজে আরো একটি খারাপ অথবা ভয়ঙ্কর প্রথা ছিল অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ যাকে সাধারণত বাল্যবিবাহ বলা হয়। সেসময়কার বেশিরভাগ পরিবারি ই অল্প বয়সে তাদের মেয়েদের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক অথবা বৃদ্ধ বয়স্ক লোকের বিয়ে দিত। যার ফলে মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যেত এবং তাদের কষ্টের জীবন শুরু হতো। ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশব চন্দ্র সেন সমাজে প্রচলিত এই খারাপ প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। কেশব চন্দ্রসেন এবং সমগ্র ব্রাহ্ম সমাজ সরকারের কাছে এই বাল্যবিবাহ বন্ধ করার আবেদন জানায়। সরকার ব্রাহ্মসমাজের এই তীব্র আন্দোলনের চাপে পড়ে 1872 খ্রিস্টাব্দে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট বা তিন আইন পাস করে বাল্যবিবাহ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে। যার ফলে সেই সময়কার নারীরা অল্প বয়সে সংসারের চাপে পড়ে নাজেহাল ও বিধবা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।
◆ নারী শিক্ষা : রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় সমাজে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়। এবং কেশবচন্দ্র সেন এবং সমগ্র ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে সমাজে বাল্যবিবাহের মত কিছু প্রথা সরকারিভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখানে ব্রাহ্মসমাজ এখানেই থেমে থাকেনি। ব্রাহ্মসমাজ চেয়েছিল সমাজে নারীদের শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়ন করা। কারণ তারা এই ব্যাপারটা জানতো যে,সমাজ তখনই উন্নত হবে বা শিক্ষিত হয়ে উঠবে বা সঠিকভাবে শিক্ষিত হয়ে উঠবে, যখন সমাজের নারীরাও সঠিকভাবে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। এজন্য ব্রাহ্মসমাজ বিভিন্ন সময়ে নারী শিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এবং ব্রাহ্মসমাজের কিছু উদ্যোগ গ্রহণের ফলে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে বাঙালি নারীরা শিক্ষাপাভের সুযোগ পেয়েছিল।
◆ নৌশ বিদ্যালয় : ব্রাহ্মসমাজের সমাজ সংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো - ব্রাহ্মসমাজ শ্রমিক, কৃষক এবং অন্যান্য শ্রেণীর জন্য,যারা প্রথমে শিক্ষালাভ করতে পারেনি,তাদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল। ব্রাহ্মসমাজ চেয়েছিল যাতে শ্রমিক, কৃষক এবং অন্যান্য শ্রেণীর মানুষেরা ন্যূনতম শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে নিজেদের অধিকার টুকু বুঝে নিতে পারে। এবং তারা এজন্যই নৌশ বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের জন্য শিক্ষা লাভের ব্যবস্থা করেছিল।
◆ জনসাধারণের পাশে দাঁড়ানো : সমাজ সংস্কারে উপরিক্ত নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়াও, ব্রাহ্মসমাজ সেই সময়ে বিভিন্ন দুর্ভিক্ষ, মহামারী অথবা অন্যান্য পরিস্থিতিতে জনসাধারণের পাশে এসে দাঁড়াতেও দ্বিধাবোধ করেনি। ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং সকল সদস্যরা বিভিন্ন সময় মহামারী, দুর্ভিক্ষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ত্রাণকার্য, উদ্ধারকার্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিজেরা ঝাপিয়ে পরেছিল।
◆ ধর্ম সংস্কারে : ব্রাহ্মসমাজের নেতারা তাদের বিভিন্ন সভা সমিতির এবং পত্র-পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে হিন্দু সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা, অন্ধবিশ্বাস,জাতিভেদ প্রথা,অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি জিনিস গুলোকে খুবই কড়াভাবে আক্রমণ করে। এবং এর বিরুদ্ধে আধুনিক চিন্তাধারা এবং যুক্তিবাদী মতবাদ প্রকাশ করার মাধ্যমে সমাজ থেকে এই সমস্ত জিনিস গুলি দূর করার চেষ্টা করে।
◆ শ্রমিক শ্রেণি সমর্থন : ব্রাহ্মসমাজ সমাজ শ্রমিকশ্রেণীকে সমর্থন করেছিল। ব্রাহ্ম সমাজের নেতা বা সদস্য শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের " ভারত শ্রমজীবী " নামক একটি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে সেখানে শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার সম্পর্কে লেখালেখি করতেন। এছাড়াও রামকুমার বিদ্যারত্ন কুলি কাহিনী নামক গ্রন্থে কুলি শ্রমজীবী মানুষদের উপর হওয়া বিভিন্ন নির্মম অত্যাচার সম্পর্কে লেখালেখি করেছিলেন। এছাড়াও ব্রাহ্মসমাজের নেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রীও এক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গিয়েছিলেন।
উপসংহার : সুতরাং দেখা যায় 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা বা 1830 খ্রিস্টাব্দের ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজা রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন,শিবনাথ শাস্ত্রী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর,বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও ব্রাহ্ম সমাজের অন্যান্য নেতা এবং সদস্যদের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ বাংলায় বিভিন্ন ধরনের সমাজ সংস্কার করে গেছেন। এবং ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে গ্রহণ করা বিভিন্ন উদ্যোগ, এবং আন্দোলন, প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কিছু ক্ষেত্রে সমাজ আধুনিক হয়ে উঠেছিল এবং বাকি ক্ষেত্রে আধুনিক হয়ে ওঠার পথ খুঁজে পেয়েছিল।
আশাকরি যে, আজকের এই পোস্ট থেকে সংস্কার বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা অধ্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সমাজ সংস্কারে ব্রাহ্মসমাজ এর কি ভূমিকা ছিল অথবা সমাজ সংস্কারে ব্রাহ্ম সমাজের অবদান সম্পর্কে লেখ - এর একটি সুন্দর ইতিহাস নোট পেয়ে গেছো। যদি আজকের এই দশম শ্রেণির ইতিহাস নোট ( class 10 history notes in Bengali ) টি ভালো লেগে থাকে, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটের অন্যান্য Educational Post গুলো পড়ে দেখো।
Tags :