![]() |
গান্ধীজীর রাজনৈতিক দর্শনের মূল সূত্র গুলি আলোচনা করো |
আজকের এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমরা দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান পঞ্চম অধ্যায় বা উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান পঞ্চম অধ্যায় কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক মতাদর্শের (WBCHSE Class 12 Political Science Question Answer Chapter 1 In Bengali ) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বা বিষয় "গান্ধীজীর রাজনৈতিক দর্শনের মূল সূত্র গুলি আলোচনা করো || WB Class 12 Political Science Note 2023" এর উওর তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো।
গান্ধীজীর রাজনৈতিক দর্শনের মূল সূত্র গুলি আলোচনা করো
অথবা
গান্ধীবাদী দর্শনের মৌলিক নীতি সমূহ আলোচনা করো
অথবা
গান্ধীবাদী দর্শনের মৌলিক নীতি সমূহ আলোচনা করো
ভূমিকাঃ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কোন রাষ্ট্রদার্শনিক ছিলেন না। গান্ধীজীর ভাষায় গান্ধীবাদ বলে কিছু নেই। নতুন কোনো নীতি বা রাষ্ট্রের স্রষ্টা হিসেবে তিনি কিছু দাবি করেন না। ডেভিড থরো,জন রলস, টলস্টয়ের লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ এবং অন্যদিকে ভাগবত গীতা, উপনিষদ কোরান,বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত, প্রভৃতির শিক্ষার সমন্বয়ে গান্ধীজি তার মতবাদ তৈরি করেছিলেন। গান্ধীজীর রাজনৈতিক দর্শনের মূল শত্রু গুলি হল- অহিংসা, সত্যাগ্রহ,সর্বদায় রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা, স্বরাজ এবং অছি সক্রান্ত তত্ত্ব।
[1] অহিংসা : গান্ধিজির মতাদর্শের মূলনীতি হল অহিংসা। সাধারণভাবে অহিংসা বলতে অপরের প্রতি হিংসা না করা বোঝায় । গান্ধিজির মতে, অহিংসা বলতে ‘চরমতম স্বার্থহীনতা কে বোঝায়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে অহিংসা হল ‘ইতিবাচক ভালোবাসা'। অহিংসা দুর্বলতা নয়, অহিংসা এক নৈতিক শক্তি, এক সদর্থক ধারণা।
[2] সত্যাগ্ৰহ: আভিধানিক অর্থে সত্যাগ্রহ হল 'সত্যের জন্য আগ্রহ। গান্ধিজির সত্যাগ্রহের আদর্শ হল সত্যের জন্য তপস্যা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। সত্যাগ্রহ দুর্বলের অস্ত্র নয়, এটি একটি আত্মিক শক্তি। সত্যাগ্রহে কাপুরুষতা বা ভীরুতার কোনো স্থান নেই। গান্ধিজির সত্যাগ্রহ হল এমন এক আদর্শ যেখানে প্রেম ও ভালোবাসার সাহায্যে প্রতিপক্ষের হৃদয় পরিবর্তন করা যায়। সত্যাগ্রহের পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে প্রতীকী বা আমরণ অনশন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট প্রভৃতি।
[3] সর্বোদয়: ‘সর্ব' এবং 'উদয়' এই দুটি শব্দ নিয়ে হয় সর্বোদয়। সর্বোদয়ের আক্ষরিক অর্থ হল সকলের কল্যাণ (Uplift of all)। সমাজে এক উন্নত নৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা সর্বোদয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য। সত্য, অহিংসা এক সৎ উপায়ের সাহায্যে এই পরিবেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে গান্ধিজি মনে করতেন। অনাড়ম্বর জীবনযাপন ও মহৎ চিন্তার মাধ্যমে পারস্পরিক প্রেমকখন ও সহযোগিতার ভিত্তিতে এই সর্বোদয় সমাজ গঠন করা সম্ভব। সর্বোদয়ে গ্রামভিত্তিক সভ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সর্বোদয় অর্থনীতি হবে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প নির্ভর। আধুনিক বৃহৎ শিল্প সভ্যতাকে সর্বোদয় সমর্থন করে না।
[4] রাষ্ট্র-সম্পর্কিত ধারণা: রাষ্ট্র প্রকৃতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে। গান্ধিজি বলেছিলেন, “রাষ্ট্রের শক্তি-বৃদ্ধির ঘটনাকে আমি সবচেয়ে ভয়ের চোখে দেখে থাকি।” গান্ধিজির মতে, বলপ্রয়োগ হল আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি । গান্ধিজি মনে করতেন, মানুষের দুর্বলতার জন্য রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র যে চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী একটি প্রতিষ্ঠান গান্ধিজি তা বিশ্বাস করতেন না। তিনি সম্পূর্ণ নৈতিক কর্তৃত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত জনগণের সার্বভৌমিকতায় আস্থাশীল ছিলেন তিনি মনে করতেন, সেই রাষ্ট্রই সবচেয়ে ভালো যা সবচেয়ে কম শাসন করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী গান্ধিজি এভাবে রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন। আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ‘রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র’ থাকবে বলে গান্ধিজি মনে করতেন রাষ্ট্রহীন এই গণতন্ত্র হল গান্ধিজির রামরাজ্য যাকে গ্রামভিত্তিক করে গড়ে তুলতে তিনি পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা পত্তনের কথা বলেছিলেন।
[5] স্বরাজ সম্পর্কিত ধারণা: 'স্বরাজ' কথাটির অর্থ হল স্ব-রাজ্য বা স্ব শাসন। সাধারণ অর্থে স্বরাজ হল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। তাঁর মতে, স্বরাজ হল এক আদর্শ মানবসমাজ, এক উন্নততর সামাজিক অবস্থা, যার মূল ভিত্তি হল পরিপূর্ণ সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার। গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন, একটি জাতির জন্য স্বরাজের অর্থ হল সেই জাতির আত্মঅনুশাসন।
[6] গ্রামীণ পুনর্গঠনের ধারণা: কৃষিপ্রধান ভারতের উন্নয়নের জন্য গান্ধিজি গ্রামীণ পুনর্গঠনের ধারণার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন, ভারতের প্রাণশক্তি গ্রামগুলির উন্নতির মধ্যে নিহিত রয়েছে। গ্রামীণ ভারতের পুনর্গঠনের জন্য গান্ধিজি যে বিষয়গুলির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সমবায় প্রথার প্রচলন, জমিদারি প্রথার সংস্কার, গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ, গ্রাম-স্বরাজ, স্বাবলম্বন প্রভৃতি।
[7] গণতন্ত্র-সম্পর্কিত ধারণা: গান্ধিজির মতে, প্রকৃত গণতন্ত্র কখনও অসত্য ও সহিংস পথে আসতে পারে না। গণতন্ত্র ও হিংসা পাশাপাশি চলা দুষ্কর। পশ্চিমের গণতন্ত্রকে তিনি 'নামমাত্র গণতন্ত্র' বলেছেন। গণতন্ত্রে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে গান্ধিজির অভিমত ছিল, মানুষ হিসেবে যারা ভালো ও খাঁটি তাদের মধ্যে থেকেই প্রতিনিধি বাছাই করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় না বলে তাকে তিনি প্রকৃত গণতন্ত্রের মর্যাদা দেননি। গণতন্ত্রে সংখ্যার চেয়ে গুণকে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। পারস্পরিক সহনশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গণতন্ত্রের ভিত্তি বলে গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন। গান্ধিজি পঞ্চায়েতিরাজ থেকে এই গণতন্ত্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
[8] অছি-সম্পর্কিত তত্ত্ব : গান্ধিজির অছি-সম্পর্কিত তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, সমাজের ধনী ব্যক্তিরা তাদের ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে সম্পদের বাকি অংশটুকু সর্বসাধারণের জন্য দান করবে। অছি হিসেবে তারাই অতিরিক্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। এর ফলে সমস্ত রকম শ্রেণিদ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং সমাজে নৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। গান্ধিজির মতে, অছি-রক্ষা বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজকে সাম্যবাদী সমাজে পরিবর্তিত করার উপায়। এই ব্যবস্থা পুঁজিবাদকে সমর্থন করে না, কিন্তু বর্তমান মালিকশ্রেণিকে আত্মসংশোধনের সুযোগ দেয়।
[9] জাতীয়তাবাদ-সম্পর্কিত ধারণা: জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়ে গান্ধিজি বলেছিলেন যে, তাঁর কাছে দেশপ্রেম ও মানবতা সমার্থক। তাঁর মতে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আগ্রাসী বা ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির নয়। সংকীর্ণ জাতিবিদ্বেষ বা উগ্র স্বাদেশিকতাকে জাতীয়তাবাদে স্থান দেননি গাম্পিজি। তাঁর চিন্তাধারায় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনো বিরোধ ছিল না।
Tags :