দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা কি? এর ফলাফল লেখ || উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বড় প্রশ্ন উওর 2023

0

 

দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা কি? এর ফলাফল লেখ || উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বড় প্রশ্ন উওর 2023
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা কি? দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলাফল 


দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা কি? এর ফলাফল লেখ || উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বড় প্রশ্ন উওর 2023


উওরঃ- ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলা নবাব নজমউদ্দৌলার সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তির মাধ্যমে নবাবের সকল প্রকার প্রশাসনিক এবং সামরিক ক্ষমতা কোম্পানির মনোনীত নায়েক নিজামের হাতে চলে যায়। এবং নবাব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন। এরপর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই আগস্ট ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করলে রাজস্ব সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা কোম্পানির হাতে চলে যায়। এরপর ব্রিটিশ সরকার বাংলায় মোঃ রেজা খাঁ এবং বিহারে সীতা রায়কে নায়েব-সুবা পদে নিযুক্ত করে তাদের হাতে মূলত রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে দেয়। তৎকালীন সময়ে নবাব প্রকৃত শাসক হলেও তার হাতে মূলত কোনো প্রকারেরই ক্ষমতাই ছিল না। অপরপক্ষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রকৃতপক্ষে শাসক না হলেও তারাই মূলত শাসনকার্য পরিচালনা করতো। এইভাবে বাংলায় নবাবের হাতে ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং অপরদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দায়িত্বহীন ক্ষমতা শুরু হয়েছি বাংলার নবাব এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে এই দ্বিমুখী শাসন ই ইতিহাসে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলাফলঃ-

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানী লাভের পর বাংলা নবাবকে তারা শুধুমাত্র নামমাত্র সিংহাসনে বসিয়ে তার যাবতীয় ক্ষমতা মূলত নিজেরাই ব্যবহার করতো। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং তাদের নায়েব নাজিমরা ইচ্ছে মত বাংলার সম্পদ ব্যবহার করতো। বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে যে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল গুলি দেখা দিয়েছিল, তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ফলাফল হলো-

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্থিক শোষণঃ

দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানি বাংলায় তীব্র আর্থিক শোষণ শুরু করে। দেওয়ানি লাভের আগে ১৭৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে ১ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এক বছর পর দেওয়ানি লাভ করে কোম্পানি ১৭৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় করে প্রায় দ্বিগুণ — ২ কোটি ২০ লক্ষ। রাজস্ব আদায়কারীদের তাঁর অত্যাচার সাধারণ মানুষের জীবন অভিষ্ট করে তোলে। ইজাদারদের দ্বারা কৃষকদের উচ্ছেদঃ
বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পূর্বে কৃষকদের জমি থেকে করা হত না। দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজরা সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানে প্রতিশ্রুতিদানকারী ইজারাদারকে জমি ইজারা দিতে শুরু করে। কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পরিশোধ করতে গিয়ে ইজারাদারও কৃষকদের ওপর রাজস্বের হার অত্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। এই রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া

কোম্পানির বাংলার রাজস্ব ব্যবহারঃ

আগে ভারতে কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য ইংল্যান্ড থেকে অর্থ পাঠানো হত। দেওয়ানি লাভের পর ইংল্যান্ড থেকে অর্থ পাঠানো বন্ধ হয় এবং বাংলার রাজস্বের অর্থ নিয়ে পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা হয়। এই পণ্য বিক্রির লাভের অর্থ বিলেতে চলে যেতে থাকে।
 

বাংলায় একচেটিয়া বাণিজ্যঃ

পলাশীর যুদ্ধ এবং ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধের পূর্বে বাংলায় ব্রিটিশদের ছাড়াও অন্যান্য দেশীয় ও বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যিক অধিকার ছিল। কিন্তু দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর বাংলায় দেশীয় এবং বৈদেশিক বণিকরা বাণিজ্য করার অধিকার হারায়। কোম্পানি বাংলায় লবণ, সুপারি, তামাক ও অন্যান্য কয়েকটি পণ্যের ওপর কোম্পানি ও তার কর্মচারিরা একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পায়। এর ফলে দেশীয় বণিকরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রব্যমূল্যও অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। সমকালীন ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন লিখেছেন যে, বাণিজ্যের কোনো শাখাই আর উন্মুক্ত নয়—সব শাখাই হয়। কোম্পানি বা তার কর্মচারিদের দখলে চলে গেছে।
 

কোম্পানির কর্মচারীদের লুণ্ঠনঃ

দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানি ও তার কর্মচারিরা বাংলায় অবাধ লুণ্ঠন শুরু করে। এ সম্পর্কে স্বয়ং ক্লাইড বলেছেন যে, “আমি শুধু এটুকুই বলছি যে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত অরাজকতা, বিভ্রান্তি, ঘুষ, দুর্নীতি এবং উৎপীড়ন শোষণের ঘটনা কেউ শোনেনি বা দেখেনি—যতটুকুর লীলাক্ষেত্র হয়েছিল এই বাংলাদেশ। এত বিপুল সম্পদ এত অবৈধ উপায়ে এত উন্মুক্ত লালসার প্রেরণায় আর কোনো দেশ থেকে লুণ্ঠিত হয়নি।"

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতিঃ

দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানির কর্মচারিরা ব্যাপক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। জর্জ কর্নওয়াল পার্লামেন্টে সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে, “আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে একথা জানাতে চাই যে, ১৭৬৫-৮৪ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অপেক্ষা বেশি দুর্নীতিপূর্ণ, বেশি ভণ্ড, বেশি অত্যাচারি ও লুণ্ঠন প্রবৃত্তির তথাকথিত সভ্য সরকার পৃথিবীর বুকে আর দেখা যায়নি।” কোম্পানির কর্মচারি বোল্টস্ লিখেছেন যে, কোম্পানির কর্মচারিদের নির্যাতন ও দুর্নীতিতে সাধারণ মানুষের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিল। ( বিশৃঙ্খলা : দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলার সমাজ ও জনজীবনে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঐতিহাসিক জনকে বলেছেন যে, দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল করে তোলে।

দ্বৈত শাসন ব্যবসার অবসানঃ

দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা ভারতীয়দের পক্ষে কখনোই কল্যাণকর ছিল না  সেইসঙ্গে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বাংলার এই ভয়াবহ পরিস্থিতিকে ঠিক করার জন্য এবং কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ জানার জন্য ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে ভারতের গভর্নর জেনারেল পদের সৃষ্টি করে,ওয়ারেন্ট হেস্টিংসকে ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে পাঠায়। ওয়ারেন্ট হেস্টিংস ভারতের আসার পরেই তিনি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবস্থান ঘটান। এভাবে কোম্পানির সেই অরাজকতা বন্ধ হয়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top