তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম গল্প মাতু পাগলী- দ্বিতীয় ভাগ || বাংলা ভূতুড়ে ছোট গল্প || Bengali Short Horror Stories

0

 

তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম গল্প মাতু পাগলী- দ্বিতীয় ভাগ || বাংলা ভূতুড়ে ছোট গল্প


আজকের এই ব্লগের মাধ্যমে আমি শেয়ার করতে যাচ্ছি তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ( Taradas Bandopadhyay ) রচিত তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম গল্প মাতু পাগলীর গল্প( First Story Of Taranath Tantrik By Taradas Bandopadhyay ) তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম গল্প মাতু পাগলীর গল্পটিকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করেছিলাম। এর আগে আমরা এই First Part শেয়ার করেছিলাম। আজকে আমরা তারা তান্ত্রিকের প্রথম গল্প মাতু পাগলীর গল্পের দ্বিতীয়ভাগ শেয়ার করতে যাচ্ছি।

তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম গল্প মাতু পাগলী- দ্বিতীয় ভাগ || বাংলা ভূতুড়ে ছোট গল্প || Bengali Short Horror Stories 


তখনই মনে পড়ল পাগলীর মুখে শুদ্ধ সংস্কৃত শ্লোক শুনেছি, তন্ত্রের কথা শুনেছি। সময়ে সময়ে সত্যই এমন কথা বলে যে, ওকে বিদুষী ব’লে সন্দেহ হয়। সেইদিন থেকে পাগলী আমার ওপর প্রসন্ন হ'ল। বিকেলে যখন গেলাম, 

তখন আপনিই ডেকে বললে আমার রাগ হ’লে আর জ্ঞান থাকে না, তোকেও ওবেলা গালাগাল দিয়েছি, কিছু মনে করিস নে। ভালোই হয়েছে, তুই সাধনা করতে চাস্ নি। ও সব নিম্ন-তন্ত্রের সাধনা। ওতে মানুষের কতকগুলো শক্তি লাভ হয়। তা ছাড়া আর কিছু হয় না।

বললাম—কি ভাবে শক্তি লাভ হয় ? পাগলী বললে— পৃথিবীতে নানা রকম জীব আছে তাদের চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষ ম'রে দেহশূন্য হ'লে চোখে দেখা যায় না, আমরা তাদের বলি ভূত। এ ছাড়া আরও অনেক রকম প্রাণী আছে, তাদের বুদ্ধি মানুষের চেয়ে কম, কিন্তু শক্তি বেশি। এদেরও দেখা যায় না। তন্ত্রে এদের ডাকিনী, শাঁখিনী এই সব নাম। এরা কখনও মানুষ ছিল না, মানুষ ম'রে যেখানে যায়, এরা সেখানকার প্রাণী। মুসলমান ফকিরেরা এদের জিন বলে। এদের মধ্যে ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। তন্ত্রসাধনার বলে এদের বশ করা যায়। তখন যা বলা যায় এরা তাই করে। করতেই হবে, না করে উপায় নেই। কিন্তু এদের নিয়ে খেলা করার বিপদ আছে। অসাবধান তুমি যদি হয়েছ, তোমাকে মেরে ফেলতে পারে।

অবাক্ হয়ে ওর কথা শুনছিলাম। এসব কথা আর কখনও শুনি নি। এর মতো পাগলের মুখেই এ-কথা সাজে। আর যেখানে বসে শুনছি, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থাও এই কথার উপযুক্ত বটে। গ্রাম শ্মশান, একটা বড় তেঁতুলগাছ আর এক দিকে কতকগুলো শিমুল গাছ। দু-চার দিন আগের একটা চিতার কাঠকয়লা আর একটা কলসী জলের ধারে পড়ে রয়েছে। কোনোদিকে লোকজন নেই। অজ্ঞাতসারে আমার গা যেন শিউরে উঠল।

পাগলী তখনও ব'লে যাচ্ছে। অনেক সব কথা, অদ্ভুত ধরনের কথা ! — এক ধরনের অপদেবতা আছে, তন্ত্রে তাদের বলে হাঁকিনী। তারা অতি ভয়ানক জীব। বুদ্ধি মানুষের চেয়ে অনেক কম, দয়া মায়া ব’লে পদার্থ নেই তাদের। পশুর মতো মন। কিন্তু তাদের ক্ষমতা সব চেয়ে বেশি। এরা যেন প্রেতলোকের বাঘ-ভালুক। ওদের দিয়ে কাজ বেশি হয় ব'লে যাদের বেশি দুঃসাহস, এমন তান্ত্রিকেরা হাঁকিনীমন্ত্রে সিদ্ধ হবার সাধনা করে। হ'লে খুবই ভালো, কিন্তু বিপদের ভয়ও পদে পদে। তাদের নিয়ে যখন তখন খেলা করতে নেই, তাই তোকে বারণ করি। তুই বুঝিস্ নে, তাই রাগ করিস্।

কৌতূহল আর সংবরণ করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম— তুমি তাহ'লে

হাঁকিনীমন্ত্রে সিদ্ধ, না? ঠিক বল। পাগলী চুপ করে রইল।

আমি তাকে আর প্রশ্ন করলাম না, বুঝলাম পাগলী এ-কথা কিছুতেই বলবে

না। কিন্তু এ-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ রইল না। পরদিন গ্রামের লোকে আমাকে পাগলীর সম্বন্ধে অনেক কথা বললে। বললে—আপনি ওখানে যাবেন না অত ঘন ঘন। পাগলী ভয়ানক মানুষ, ওর মধ্যে এমন শক্তি আছে, আপনার একেবারে সর্বনাশ করে দিতে পারে। ওকে বেশি ঘাঁটাবেন না মশায়। গাঁয়ের লোক ওর কাছেও ঘেঁষে না। বিদেশী লোক মারা পড়বেন শেষে ?

মনে ভাবলাম, কি আমার করবে, যা করবার তা করেছে। তার কাছে না গিয়ে থাকবার শক্তি আমার নেই।

তার পরে একদিন যা হ'ল, তা বিশ্বাস করবেন না। একদিন সন্ধ্যের পরে পাগলীর কাছে গিয়েছি, কিন্তু এমন ভাবে গিয়েছি পাগলী না টের পায়। পাগলীর সেই বটতলায় গিয়ে হঠাৎ অবাক্ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বটতলায় পাগলী বসে নেই, তার বদলে একটি ষোড়শী বালিকা গাছের

গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে রয়েছে। চোখের ভুল নয় মশায়, আমার

তখন কাঁচা বয়েস, চোখে ঝাপ্‌সা দেখবার কথা নয়, স্পষ্ট দেখলাম।

ভাবলাম, তাই তো! এ আবার কে এল ? যাই কি না যাই ? দু-এক পা এগিয়ে সঙ্কোচের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, মা, তিনি কোথায় গেলেন ?

মেয়েটি হেসে বললে, কে?

—সেই তিনি, এখানে থাকতেন।

মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল- আ মরণ, কে তার নামটাই বল

না-নাম বলতে লজ্জা হচ্ছে নাকি ?

আমি চমকে উঠলাম। সেই পাগলীই তো! সেই হাসি, সেই কথা বলবার

ভঙ্গি। এই ষোড়শী বালিকার মধ্যে সেই পাগলী রয়েছে লুকিয়ে! সে এক অদ্ভুত আকৃতি, ভেতরে সেই পরিচিতা পাগলী, বাহিরে এক অপরিচিতা রূপসী ষোড়শী বালিকা ।

মেয়েটি হেসে ঢ'লে পড়ে আর কি। বললে- এসো না, ব'স না এসে পাশে

লজ্জা কি ? আহা, আর অত লজ্জায় দরকার নেই। এসো হঠাৎ আমার বড় ভয় হ’ল। মেয়েটির রকম-সকম আমার ভালো ব'লে মনে

হ'ল না- তা ছাড়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস হ'ল এ পাগলীই, আমায় কোনো বিপদে ফেলবার চেষ্টায় আছে। ফিরে চলে যাচ্ছি, এমন সময়ে পরিচিত কন্ঠের ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালাম,

দেখি বটতলায় পাগলী বসে আছে—আর কেউ কোথাও নেই। আমার তখনও ভয় যায় নি। ভাবলাম, আজ আর কিছুতেই এখানে থাকব

না, আজ ফিরে যাই। পাগলী বললে-এসো, ব’স। বললাম— তুমি ও রকম ছোট মেয়ে সেজেছিলে কেন? তোমার মতলবখানা কি?

পাগলী বললে-আ মরণ, ঘাটের মড়া, আবোল-তাবোল বকছে। বললাম—না, সত্যি কথা বলছি, আমায় কোনো ভয় দেখিও না। যখন তোমায় মা ব'লে ডেকেছি।

পাগলী বললে— শোন্ তবে। তুই সে-রকম নস্। তন্ত্রের সাধনা তোকে দিয়ে হবে না, অত সাধু সেজে থাকবার কাজ নয়। থাক, তোকে দু-একটা কিছু দেব, তাতেই তুই ক'রে খেতে পারবি। একটা মড়া চাই। আসবে শিগ্‌গির অনেক মড়া, এই ঘাটেই আসবে। ততদিন অপেক্ষা কর্। কিন্তু যা ব'লে দেব, তাই করবি। রাজী আছিস্? শবসাধনা ভিন্ন কিছু হবে না।

তখন আমি মরীয়া হয়ে উঠেছি। আমি ভীতু লোক ছিলাম না কোনো কালেই, তবু কখনও মড়ার উপর ব'সে সাধনা করব এ-কল্পনাও করি নি। কিন্তু রাজী হ'লাম পাগলীর প্রস্তাবে। বললাম- বেশ, তুমি যা বলবে তাই করব। কিন্তু পুলিসের হাঙ্গামার মধ্যে যেন না পড়ি। আর সব তাতে রাজী আছি।

একদিন সন্ধ্যের কিছু আগে গিয়েছি। সেদিন দেখলাম পাগলীর ভাবটা যেন কেমন কেমন। ও আমায় বললে—একটা মড়া পাওয়া গিয়েছে, চুপি চুপি এসো। জলের ধারে বড় একটা পাকুড় গাছের শেকড় জলের মধ্যে অনেকখানি নেমে গিয়েছে। সেই জড়ানো পাকানো জলমগ্ন শেকড়ের মধ্যে একটা ষোল সতের বছরের মেয়ের মড়া বেধে আছে। কোন্ ঘাট থেকে ভেসে এসেছে বোধহয়। ও বললে, তোল্ মড়াটা-শেকড় বেয়ে নেমে যা। জলের মধ্যে মড়া হালকা

হবে। ওকে তুলে শেকড়ে রেখে দে। ভেসে না যায়। তখন কি করছি জ্ঞান ছিল না। মড়ার পরনে তখনও কাপড়, সেই কাপড় জড়িয়ে গিয়েছে শেকড়ের মধ্যে। আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হ'ল না ; অল্প চেষ্টাতেই সেটা টেনে তুলে ফেললাম। পাগলী বললে—মড়ার ওপর ব'সে তোকে সাধনা করতে হবে-ভয় পাবিনে তো ? ভয় পেয়েছ কি মরেছ।

আমি হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে চিৎকার ক'রে উঠলাম। মড়ার মুখ তখন আমার নজরে পড়েছে। সেদিনকার সেই ষোড়শী বালিকা। অবিকল সেই মুখ, সেই চোখ, কোনো তফাত নেই। পাগলী বললে— চেঁচিয়ে মরছিস্ কেন, ও আপদ ? আমার মাথার মধ্যে কেমন গোলমাল হয়ে গিয়েছে তখন। পাগলীকে দেখে

তখন আমার অত্যন্ত ভয় হ'ল। মনে ভাবলাম, এ অতি ভয়ানক লোক দেখছি।

গাঁয়ের লোকে ঠিকই বলে।

কিন্তু ফিরবার পথ তখন আমার বন্ধ। পাগলী আমায় যা যা করতে বললে, সন্ধ্যে থেকে আমাকে তা করতে হ'ল।

শবসাধনার অনুষ্ঠান সম্বন্ধে সব কথা তোমায় বলবারও নয়। সন্ধ্যের পর থেকেই আমি শবের ওপর আসন ক'রে বসলাম। পাগলী একটা অর্থশূন্য মন্ত্র আমাকে বললে—সেটাই জপ করতে হবে অনবরত। আমার বিশ্বাস হয় নি যে, এতে কিছু হয়। এমন কি, ও যখন বললে- যদি কোনো বিভাষিকা দেখ, তবে ভয় পেয়ো না। ভয় পেলেই মরবে।—তখনও আমার মনে বিশ্বাস হয় নি। রাত্রি দুপুর হ’ল ক্রমে। নির্জন শ্মশান, কেউ কোনো দিকে নেই, নীরন্ধ

অন্ধকার দিগবিদিক্ লুকিয়েছে। পাগলী যে কোথায় গেল, তাও আমি আর দেখিনি। হঠাৎ এক পাল শেয়াল ডেকে উঠল নদীর ধারে একটা কষাড় ঝোপের আড়ালে। শেয়ালের ডাক তো কতই শুনি, কিন্তু সেই ভয়ানক শ্মশানে একটা টাটকা মড়ার ওপর ব'সে সেই শেয়ালের ডাকে আমার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল।

ঠিক সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ব্যাপার ঘটল। বিশ্বাস করা-না-করা তোমার ইচ্ছে—কিন্তু তোমার কাছে মিথ্যে ব'লে কোনো স্বার্থ নেই। আমি তারানাথ জ্যোতিষী, বুঝি কেবল পয়সা — তুমি আমাকে এক পয়সা দেবে না। সুতরাং তোমার কাছে মিথ্যে বলতে যাব কেন?

শেয়াল ডাকার সঙ্গে আমার মনে হ’ল শ্মশানের নিচে নদীজল থেকে দলে দলে সব বৌ-মানুষরা উঠে আসছে—অল্পবয়সী বৌ, মুখে ঘোমটা টানা, জল থেকে উঠে এল অথচ কাপড় ভিজে নয় কারো। দলে দলে একটা, দুটো, পাঁচটা, দশটা, বিশটা ।

তারা সকলে এসে আমায় ঘিরে দাঁড়াল— আমি একমনে মন্ত্র জপ করছি। ভাবছি—যা হয় হবে।

একটু পরে ভালো ক'রে চাইতে গিয়ে দেখি, আমার চারপাশে একটাও বৌ নয়, সব করা পাখি, বীরভূমে নদীর চরে যথেষ্ট হয়। দু-পায়ে গম্ভীর ভাবে হাঁটে ঠিক যেন মানুষের মতো।

এক মুহূর্তে মনটা হালকা হয়ে গেল—তাই বল! হরি হরি ! পাখি! চিন্তাটা আমার সম্পূর্ণ শেষ হয় নি-পরক্ষণে আমার চারপাশে মেয়েগলায় কারা খলখল করে হেসে উঠল।

হাসির শব্দে আমার গায়ের রক্ত আরও হিম হয়ে জমে গেল যেন। চেয়ে দেখি তখন একটাও পাখি নয়, সবই অল্পবয়সী বৌ। তারা তখন সবাই একযোগে ঘোমটা খুলে আমার দিকে চেয়ে আছে।.... আর তাদের চারদিকে, সেই বড় মাঠের যেদিকে তাকাই, অসংখ্য নরকঙ্কাল দূরে, নিকটে, ডাইনে, বায়ে, অন্ধকারের মধ্যে সাদা সাদা দাঁড়িয়ে আছে। কত কালের পুরোনো জীর্ণ হাড়ের কঙ্কাল, তাদের অনেকগুলোর হাতের সব আঙুল নেই, অনেকগুলোর হাড় রোদে জলে চটা উঠে ক্ষয়ে গিয়েছে, কোনোটার মাথার খুলি ফুটো, কোনোটার পায়ের নলির হাড় ভেঙে বেঁকে আছে। তাদের মুখও নানাদিকে ফেরানো দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, কেউ যেন তাদের বহু যত্নে তুলে ধ’রে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কঙ্কালের আড়ালে পেছন থেকে যে লোকটা এদের খাড়া করে রেখেছে, সে যেই ছেড়ে দেবে, অমনি কঙ্কালগুলো হুড়মুড় ক'রে ভেঙ্গে পড়ে গিয়ে জীর্ণ ভাঙাচোরা তোবড়ানো, নোনা-ধরা হাড়ের রাশি স্তূপাকার হয়ে উঠবে। অথচ তারা যেন সবাই সজীব, সকলেই আমাকে পাহারা দিচ্ছে, আমি যেন প্রাণ নিয়ে এ শ্মশান থেকে পালাতে না পারি। হাড়ের হাত বাড়িয়ে একযোগে সবাই যেন আমায় গলা টিপে মারবার অপেক্ষায় আছে।


উঠে সোজা দৌড় দেব ভাবছি, এমন সময় দেখি আমার সামনে এক অতি রূপসী বালিকা আমার পথ আগলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। এ আবার কে? যা হোক্, সব রকম ব্যাপারের জন্যে আজ প্রস্তুত না হয়ে আর শবসাধনা করতে নামি নি। আমি কিছু বলবার আগে মেয়েটি হেসে হেসে বললে- আমি ষোড়শী, মহাবিদ্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আমায় তোমার পছন্দ হয় না ?

মহাবিদ্যা-টহাবিদ্যার নাম শুনেছিলাম বটে পাগলীর কাছে, কিন্তু তাঁদের তো শুনেছি অনেক সাধনা ক'রেও দেখা মেলে না, আর এত সহজে ইনি.....বললাম আমার মহাসৌভাগ্য যে আপনি এসেছেন....আমার জীবন ধন্য হলো।

মেয়েটি বললে—তবে তুমি মহাডামরী সাধনা করছ কেন ? -আজ্ঞে, আমি তো জানি নে কোন্ সাধনা কি রকম। পাগলী আমায় যেমন

ব’লে দিয়েছে, তেমনি করছি।

—বেশ, মহাডামরী সাধনা তুমি ছাড়। ও মন্ত্র জপ ক'রো না। যখন দেখা

দিয়েছি তখন তোমার আর কিছুতে দরকার নেই। তুমি মহাডামরী ভৈরবীকে দেখ নি—অতি বিকট তার চেহারা... তুমি ভয় পাবে। ছেড়ে দাও ও মন্ত্র। সাহসে ভর ক'রে বললাম- সাধনা করে আপনাদের আনতে হয় শুনেছি, আপনি এত সহজে আমাকে দেখা দিলেন কেন? -তোমার সন্দেহ হচ্ছে?

আমার মনে হ’ল, এই মুখ আমি আগে কোথাও দেখেছি, কিন্তু তখন আমার মাথার গোলমাল হয়ে গিয়েছে, কিছুই ঠিক করতে পারলাম না। বললাম-সন্দেহ নয়, কিন্তু বড় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। আমি কিছুই জানি নে কে আপনারা..... যদি অপরাধ করি মাপ করুন, কিন্তু কথাটার জবাব যদি পাই— বালিকা বললে—মহাডামরীকে চেন না? আমাকেও চেন না? তা হলে আর

চিনে কাজ নেই। এসেছি কেন জিজ্ঞেস করছ ? দিব্যৌঘ পথের নাম শোন নি

তন্ত্রে ? পাষণ্ডদলনের জন্যে ঐ পথে আমরা পৃথিবীতে নেমে আসি। তোমার মন্ত্রে

দিব্যৌঘ পথে সাড়া জেগেছে। তাই ছুটে দেখতে এলাম।

কথাটা ভালো বুঝতে পারলাম না। ভয়ে ভয়ে বললাম, তবে আমি কি খুবই পাষণ্ড ?

বালিকা খিলখিল করে হেসে উঠল।

বললে-তোমার বেলা এসেছি সম্প্রদায় রক্ষার জন্যে.... অত ভয় কিসের!  আমি না তোকে লাথি মেরেছি ? শ্মশানের পোড়া কাঠ ছুঁড়ে মেরেছি। তোকে

পরীক্ষা না ক'রে কি সাধনার নিয়ম ব'লে দিয়েছি তোকে? আমি ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি, বলে কি? মেয়েটি আবার বললে—কিন্তু মহাডামরীর বড় ভীষণ রূপ, তোর যেমন ভয়,

সে তুই পারবি নে—ও ছেড়ে দে —আপনি যখন বললেন তাই দিলাম।

—ঠিক কথা দিলি? —দিলাম। এ সময়ে যে শবদেহের উপর বসে আছি, তার দিকে আমার নজর পড়ল। পড়তেই ভয়ে ও বিশ্বয়ে আমার সর্বশরীর কেমন হয়ে গেল! শবদেহের সঙ্গে সম্মুখের ষোড়শী রূপসীর চেহারার কোনো তফাত নেই।

একই মুখ, একই রং, একই বয়েস। বালিকা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললে–চেয়ে দেখছিস্ কি?

আমি কথার কোনো উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষণ থেকে একটা সন্দেহ আমার

মনে ঘনিয়ে এসেছিল, সেটা মুখেই প্রকাশ ক'রে বললাম-কে আপনি? আপনি কি সেই শ্মশানের পাগলীও না কি? একটা বিকট বিদ্রূপের হাসিতে রাত্রির অন্ধকার চিরে ফেড়ে চৌচির হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাঠময় নরকঙ্কাল হাড়ের হাতে তালি দিতে দিতে এঁকেবেঁকে উদ্দাম নৃত্য শুরু করলে। আর অমনি সেগুলো নাচের বেগে ভেঙে ভেঙে পড়তে লাগল। কোনো কঙ্কালের হাত খসে গেল, কোনোটার মেরুদণ্ড, কোনোটার কপালের হাড়, কোনোটার বুকের পাঁজরাগুলো— তবু তাদের নৃত্য সমানেই চলছে—এদিকে হাড়ের রাশি উঁচু হয়ে উঠল, আর হাড়ে হাড়ে লেগে কি বীভৎস ঠক ঠক শব্দ!

হঠাৎ আকাশের এক প্রান্ত যেন জড়িয়ে গুটিয়ে গেল কাগজের মতো, আর সেই ছিদ্রপথে যেন এক বিকটমূর্তি নারী উন্মাদিনীর মতো আলুথালু বেশে নেমে আসছে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে চার পাশের বনে শেয়ালের দল আবার ডেকে উঠল, বিশ্রী মড়া পচার দুর্গন্ধে চারদিক পূর্ণ হ'ল, পেছনের আকাশটা আগুনের মতো রাঙা-মেঘে ছেয়ে গেল, তার নিচে চিল, শকুনি উড়ছে সেই গভীর রাত্রে! শেয়ালের চিৎকার ও নরকঙ্কালের ঠোকাঠুকি শব্দ ছাড়া সেই ভয়ানক রাতে বাকি সব জগৎ নিস্তব্ধ, সৃষ্টি নিঝুম আমার গা শিউরে উঠল আতঙ্কে। পিশাচীটা আমার দিকেই যেন ছুটে আসছে! তার আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলন্ত দুচোখ ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা ও বিদ্রূপ মেশানো, সে কি ভীষণ ক্রুর দৃষ্টি! সে পূতিগন্ধ, সে শেয়ালের ডাক, সে আগুন রাঙা মেঘের সঙ্গে পিশাচীর সেই দৃষ্টিটা মিশে গিয়েছে একই উদ্দেশ্যে—সকলেই তারা আমায় নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করতে চায়।

যে শবটার ওপর বসে আছি - সে শবটা চিৎকার করে কেঁদে বললে আমায় উদ্ধার কর, রোজ রাত্রে এমনি হয়— আমায় খুন ক'রে মেরে ফেলেছে ব’লে আমার গতি হয় নি-আমায় উদ্ধার কর। কতকাল আছি এই শশ্মশানে। ছাপ্পান্ন বছর.... কাকেই বা বলি ? কেউ দেখে নভয়ে দিশেহারা হয়ে আমি আসন ছেড়ে উঠে দৌড় দিলাম। তখন পুবে ফরসা হয়ে এসেছে।

বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। জ্ঞান হ'লে চেয়ে দেখি আমার সামনে সেই পাগলী ব’সে মৃদু মৃদু ব্যঙ্গের হাসি হাসছে... সেই বটতলায় আমি আর পাগলী দু-জনে।।পাগলী বললে—যা তোর দৌড় বোঝা গিয়েছে। আসন ছেড়ে পালিয়েছিলি না? আমার শরীর তখনও ঝিমঝিম করছে। বললুম – কিন্তু আমি ওদের দেখেছি। তুমি যে ষোড়শী মহাবিদ্যার কথা বলতে, তিনিই এসেছিলেন। পাগলী মুখ টিপে হেসে বললে— তাই তুই ষোড়শীর রূপ দেখে মন্ত্রজপ ছেড়ে দিলি। দূর, ওসব হাঁকিনীদের মায়া। ওরা সাধনায় বাধা। তুই ষোড়শীকে চিনিস না, শ্রীষোড়শী সাক্ষাৎ ব্রহ্মশক্তি। 'এবং দেবী এ্যক্ষরীতু মহাষোড়শী সুন্দরী।'

ক'হাদি সাধনা ভিন্ন তিনি প্রকট হন না। ক'হাদি উচ্চতন্ত্রের সাধনা! তুই তার জানিস্ কি ? ওসব মায়া। আমি সন্দিগ্ধসুরে বললাম তিনি অনেক কথা বলেছিলেন যে! আরও এক।বিকটমূর্তি পিশাচীর মতো চেহারা নারী দেখেছি। আমার মাথার ঠিক ছিল না। তার পরেই মনে পড়ল, পাগলীর কথাও কি

একটা তার সঙ্গে যেন হয়েছিল— কি সেটা ? পাগলী বললে, তোর ভাগ্য ভালো। শেষকালে যে বিকটমূর্তি মেয়ে দেখেছিস্, তিনি মহাডামরী মহাভৈরবী—তুই তাঁর তেজ সহ্য করতে পারলি নে—আসন ছেড়ে ভাগলি কেন?

তারপরে সে হঠাৎ হি হি ক'রে হেসে উঠে বললে—মুখপোড়া বাঁদর কোথাকার! উনি দেখা পাবেন ভৈরবীদের! আমি যাদের নাম মুখে আনতে সাহস করি নে—হাঁকিনীদের নিয়ে কাবরার করি। ওরে অলপ্পেয়ে, তোকে ভেল্কি দেখিয়েছি। তুই তো সব সময় আমার সামনে ব'সে আছিস বটতলায়। কোথায় গিয়েছিলি তুই ? সকাল কোথায়, এখন যে সারারাত সাধনা ক'রে আসন ছেড়ে এলি? এই তো সবে সন্ধ্যে! অ্যা..

আমার চমক ভাঙল। পাগলী কি ভয়ানক লোক! সত্যিই তো সবেমাত্র সন্ধ্যা হয় হয়। আমার সব কথা মনে পড়ল। এসেছি ঠিক বিকেল—ছ-টায়। আষাঢ় মাসের দীর্ঘ বেলা। মড়া ডাঙায় তোলা, শবসাধনা, নরকঙ্কাল, ষোড়শী, উড়ন্ত চিলশকুনির ঝাঁক—সব আমার ভ্রম! হতভম্বের মতো বললাম- কেন এমন ভোলালে ? আর মিথ্যে এত ভয়

দেখালে ? পাগলী বললে-তোকে বাজিয়ে নিচ্ছিলাম। তোর মধ্যে সে-জিনিস নেই, তোর কর্ম নয়, তন্ত্রের সাধনা। তুই আর কোনোদিন এখানে আসবার চেষ্টা করবি নে। এলেও আর দেখা পাবি নে। বললাম, একটা কথার শুধু উত্তর দাও। তুমি তো অসাধারণ শক্তি ধরো।

তুমি ভেল্কি নিয়ে থাক কেন? উচ্চতন্ত্রের সাধনা কর না কেন ? পাগলী এবার একটু গম্ভীর হ'ল। বললে—তুই সে বুঝবি নে। মহাষোড়শী মহাডামরী, ত্রিপুরা, এঁরা মহাবিদ্যা। ব্রহ্ম শক্তির নারীরূপ। এদের সাধনা এব জন্মে হয় না—আমার পূর্বজন্ম এমনি কেটেছে— এ-জন্মও গেল। গুরুর দেখা পেলাম না— যা তুই ভাগ, তোর সঙ্গে এ-সব ব’কে কি করব, তোকে কিছু শক্তি

দিলাম, তবে রাখতে পারবি নে বেশি দিন। যা পালা চলে এলাম। সে আজ চল্লিশ বছরের কথা। আর যাইনি, ভয়েই যাই নি। পাগলীর দেখাও পাই নি আর কোনোদিন।

তখন আমি চিনতাম না, বয়েস ছিল কম। এখন আমার মনে হয় যে, পাগলী সাধারণ মানবী নয়। সংসারের কেউ ছিল না, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকবার জন্যে পাগল সেজে কেন যে চিরজন্ম শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়াত – তুমি আমি সামান্য মানুষে তার কি বুঝবে ? যাক সে-সব কথা। শক্তি পাগলী দিয়েছিল, কিন্তু রাখতে পারি নি । ঠিকই বলেছিল, আমার মনে অর্থের লালসা ছিল, তাতেই গেল। কেবল চন্দ্রদর্শন এখনও করতে পারি। তুমি চন্দ্রদর্শন করতে চাও ? এসো চিনিয়ে দেব। দুই হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে

আমি দেখিলাম তারানাথের বকুনি থামিবে না, যতক্ষণ এখানে আছি। উঠিয়া পড়িলাম, বেলা বারোটা বাজে। আপাতত চন্দ্রদর্শন অপেক্ষা গুরুতর কাজ বাকি। তারানাথের কথা বিশ্বাস করিয়াছি কিনা জিজ্ঞাসা করিতেছেন ? ইহার আমি কোনো জবাব দিব না।

মত্তে করেছ। আমি শব্ধে, উপায় বলে দিয়েছি মাত্র। আর একটি কথা —ভতে, বলুন।

-আমি স্বর্গে তোমাকে নিয়ে যাইনি। এখানে এই বৃক্ষতলে ব'সেই ওই সংশ্য তোমাকে দেখিয়েছি। যখন দেখলাম, তোমার তরুণ চিত্তবৃত্তি নারীতে আসক্ত, তখন সেই পথেই যাতে তুমি প্রজ্ঞা-বিমুক্তি লাভ কর, তার জন্যে ওই একটি অলীক কল্পনার আশ্রয় আমায় নিতে হয়। ওই সব অপ্সরা কোথায় ছিল না, স্বপ্নে দৃষ্ট গন্ধবনারীর মতই ওই স্বর্গও অলকি।।


আশাকরি তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম গল্প মাতু পাগলীর গল্পের প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ শেয়ার করে আপনাদের উপকার করতে পেরেছি। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটি ফলো করতে থাকুন।।

Tags : বাংলা গল্প | বাংলা ছোটো গল্প | বাংলা ভূতের গল্প | তারানাথ তান্ত্রিকের প্রথম গল্প মাতু পাগলী || তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় | Bengali Story 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top