আজকের এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমরা দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় বা উচ্চ মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় উনবিংশ ও বিংশ শতকে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ( West Bengal Board Class 12 History Question Answer & Suggestion 2023 ) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বা বিষয় 'হবসন-লেনিন তত্ত্ব বা থিসিস কী? হবসনের সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্ব এবং লেনিনের সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো' প্রশ্নটির উওর তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো।
হবসন-লেনিন তত্ত্ব বা থিসিস কী? হবসনের সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্ব এবং লেনিনের সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো
উওরঃ- ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ গুলি বিভিন্ন সময়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহন এবং উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইউরোপের দেশগুলো কী কারণে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেছিল এবং কেন বিভিন্ন উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সে সম্পর্কে জন অ্যাটকিনসন হবসন ( John Atkinson Hobson ) এবং ভি.আই.লেনিন ( V.I.Lenin ) আলোচনার মাধ্যমে যে তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন, তাই হবসন লেনিন থিসিস ( Hobson-Lenin Thesis ) অথবা হবসন লেনিন তত্ত্ব নামে পরিচিত।।
ইউরোপের শক্তিশালী দেশ গুলি সম্পর্কে হবসনের সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্বঃ-
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন অ্যাটকিনসন হবসন ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ গুলির সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ এবং উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন কারণগুলি 1902 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় সাম্রাজ্যবাদ একটি সমীক্ষা ( Imperialism A Study ) গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে জন অ্যাটকিনসম হবসনের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় গুলি হল -
পুঁজির সৃষ্টিঃ-
জন অ্যাটকিনসন হবসনের মতে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় একসময় সমাজের এক শ্রেণির হাতে বিপুল পরিমাণ পুঁজি সঞ্চার হয়। শিল্পের অগ্রগতি,সমাজে ধন সম্পদের বন্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য, বিভিন্ন বাণিজ্যের মাধ্যমে মাধ্যমে সেই পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে দিনের পর দিন পাহাড় পরিমাণ পুঁজির সঞ্চার ঘটে। পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে এই পাহাড় পরিমাণ পুঁজি সঞ্চার ঘটায়,সেই পুঁজিকে অন্যত্র কাজে লাগিয়ে অথবা অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করে তারা আরও বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য পরিকল্পনা করতো।
পুঁজিপতি শ্রেণীর সরকারের ওপর চাপঃ-
ধনতান্ত্রিক অথবা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের হাতে পাহাড় পরিমান পুঁজি হওয়ায় তারা সেই পুঁজি অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করে আরও বেশি মুনাফা অর্জনের পরিকল্পনা করে। ইউরোপের পুঁজিপতি শ্রেণি এটা বুঝতে পেরেছিল যে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে সেই পুঁজি বিনিয়োগ করে অধিক পরিমাণে মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। সেজন্য তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে অত্যধিক হারে মুনাফা অর্জনের পরিকল্পনাও করে। এবং পুঁজিপতি শ্রেণীর চাপের ফলে বিভিন্ন উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল।।
কাঁচামাল সংগ্রহ এবং বাজার দখলঃ-
জন অ্যাটকিনসন হবসন মনে করতেন যে পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজেদের হাতে থাকা পুঁজি বিনিয়োগ করে আরো বেশি মুনাফা অর্জন করা। এজন্য পুঁজিপতি শ্রেণী উপনিবেশ স্থাপন করে সেখান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করা নিজেদের দেশে শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল সংগ্রহ করে উৎপাদন বাড়ানো এবং উৎপন্ন শিল্পপণ্য অন্যান্য দেশে বিক্রির জন্য বাজার দখল করে, আরো বেশি মুনাফা অর্জন করাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য।
ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসানের উপায়ঃ-
জন অ্যাটকিনসন হবসন যেমন ঔপনিবেশিকতাবাদের বিভিন্ন কারণগুলি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, ঠিক তেমনি তিনি সাম্রাজ্যবাদ বা ঔপনিবেশিকতাবাদের অবসানের বিভিন্ন উপায় গুলি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন।যেমন -
সামাজিক সংস্কারঃ-
হবসন মনে করেন যে, পুঁজিপতি শ্রেণির বিপুল পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগের জন্য নতুন উপনিবেশ দখলের ঘটনা প্রতিহত করা সম্ভব। তিনি বলেন যে, সম্পদের সুষম বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে এর সমাধান হতে পারে।
দরিদ্রদের মধ্যে পুঁজিপতিদের অতিরিক্ত অর্থ বন্টন করাঃ-
তিনি পুঁজিপতিদের বাড়তি মূলধন দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিতরণ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যে তা ব্যবহারের কথা বলেন তাঁর মতে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে তারা কলকারখানায় উৎপাদিত উদ্বৃত্ত শিল্পসামগ্রী কিনে ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে উবৃত্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য আর উপনিবেশ দখলের প্রয়োজন হবে না।
সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতাবাদ সম্পর্কে লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বের ব্যাখ্যা-
জন অ্যাটকিনসন হবসনের মতো বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ভি.আই. লেনিন ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যের বিস্তার সম্পর্কে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি যে সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতা বাদ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অথবা সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব (Imperialism The Highest Stage Of Capitalism) পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে লেনিনের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় গুলি হল-
পুঁজিপতি শ্রেণীর উদ্ভবঃ-
লেলিন তার (Imperialism The Highest Stage Of Capitalism ) পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর গ্রন্থে পুঁজিপতি শ্রেণীর উদ্ভব অথবা উপনিবেশ দখলের প্রধান কারণ আলোচনা করেছেন। লেনিনের মতে শিল্পের অগ্রগতির ফলে ইউরোপের কয়েকটি শক্তিশালী দেশের পুঁজিপতি শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। এবং সেই পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে এক সময় প্রচুর পরিমান পুঁজির জমা হয়। পুঁজিপতি শ্রেণি সেই পুঁজি অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করে আরও বেশি মুনাফা অর্জনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু পুঁজিপতি শ্রেণী এটা জানত যে, ইউরোপে শিল্পোন্নত দেশ গুলিতে পুঁজি বিনিয়োগ করে খুব বেশি মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। সেই কারণে তারা পুঁজি বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র চাইছিল যেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করা যাবে। এই পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই ইউরোপের দেশগুলো এশিয়া,আফ্রিকা এবং আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ দখল করে সেখানে নিজের পুঁজি বিনিয়োগ করে অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্যোগ নিয়েছিল।।
বাজার দখল এবং কাঁচামাল সংগ্রহঃ-
ইউরোপে শিল্পোন্নত দেশগুলির পুঁজিপতি শ্রেণির প্রধান লক্ষ্য ছিল মুনাফা অর্জন। পুঁজিপতি শ্রেণি নিজেদের দেশে শিল্প পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্ তারা সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের পরিকল্পনাও করে। তারা সস্তায় বিভিন্ন কাঁচামাল সংগ্রহ করে করে নিজেদের দেশে তার মাধ্যমে অত্যধিক পরিমাণে শিল্পপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতো । এরপর নিজেদের দেশের চাহিদা মেটানোর পর এবং সেই অতিরিক্ত শিল্পপণ্য অন্যান্য দেশে বাজার দখল করে, সেই বাজারে নিজেদের দেশের পণ্য বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য উপনিবেশ দখলের চেষ্টা চালিয়েছিল।।
উপনিবেশে নিজেদের পুঁজি বিনিয়োগঃ-
লেলিনের মতে ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির পুঁজিপতি শ্রেণীরা নিজেদের দখল করা উপনিবেশে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী ছিল। তারা নিজেদের দখল করা উপনিবেশে নিজের পুঁজি বিনিয়োগ করে, সেখানকার কাচামালের সাহায্য সেখানেই বিভিন্ন শিল্প পণ্য উৎপন্ন করে সেখানকার বাজার দখল করে সেখানেই বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জনের চেষ্টা চালায়। লেনিনের মতে সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ সম্প্রসারিত রূপ।।
ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ গুলির মধ্যে প্রতিন্দ্বিতাঃ-
বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখলের উদ্যোগ নিলেও উপনিবেশের সংখ্যা ছিল সীমিত। ফলে উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে কাড়াকাড়ি অর্থাৎ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিযোগিতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল যুদ্ধ। যেসব ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র আগে থেকে বিভিন্ন উপনিবেশ দখল করে রেখেছে তারা তাদের উপনিবেশগুলি ধরে রাখার চেষ্টা করে। আবার পরবর্তীকালে উপনিবেশ দখলে এগিয়ে আসা রাষ্ট্রগুলি নতুন উপনিবেশ স্থাপনে ব্যর্থ হয়ে পুরোনো উপনিবেশ দখল করতে এগিয়ে এলে লড়াই শুরু হয়। লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী অর্থনীতি হল যুদ্ধের জন্মদাতা। তিনি মনে করেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল পুঁজিবাদী শক্তিগুলি কর্তৃক উপনিবেশ দখলের লড়াই।
অনুগত অভিজাত শ্রমিক শ্রেণির প্রতিষ্ঠাঃ-
লেনিন মনে করেন যে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে শ্রমিক শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের দিকেও, পুঁজিপতি শ্রেণির নজর ছিল। তারা এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত অঞ্চলগুলিকে বেছে নিয়ে সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং সেখানকার নতুন শ্রমিক শ্রেণির ওপর সীমাহীন শোষণ চালায়। এর ফলে পুঁজিপতিরা যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভ করে তার একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজ দেশের শ্রমিকদের উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের অনুগত একধরনের 'অভিজাত শ্রমিক শ্রেণি' তৈরি করে। এই শ্রমিক শ্রেণি শ্রমিক বিপ্লবের কথা ভুলে গিয়ে বুর্জোয়াদের সমর্থন করে।
আশাকরি, দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় বা উচ্চ মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় উনবিংশ ও বিংশ শতকে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ( West Bengal Board Class 12 History Question Answer & Suggestion 2023 ) থেকে যে 'হবসন-লেনিন তত্ত্ব বা থিসিস কী? হবসনের সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্ব এবং লেনিনের সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো' সম্পর্কে যে নোট দেওয়া হয়েছে, তা তোমাদের কাজে আসবে।।
Tags :
দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তর | উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় বড় প্রশ্ন উওর | দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় উনবিংশ ও বিংশ শতকে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রসার অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উত্তর | wb class 12 History question answer | wb class xii History question answer | hs History question answer & suggestion 2023