আজের এই পোস্টের মাধ্যমে নবম শ্রেণির ইতিহাস প্রথম অধ্যায় ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক (WBBSE Class 9 History Question Answer & Notes in Bengali ) অধ্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ 8 মার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন 'ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করো' এর উওর (WBBSE Class 9 Question Answer & Suggestion 2023 ) তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করবো। আর আমরা প্রতিদিন তোমাদের জন্য নোটস শেয়ার করে যাবো। তাই তোমরা আমাদের ওয়েবসাইট প্রতিদিন ভিজিট করতে থাকো
ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করো।
ভূমিকা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বিশ্ব ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য যুগান্তকারী ও সুদুরপ্রসারী ঘটনা হল ফরাসি বিপ্লব। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব পুরাতনতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সের সমাজে এক ব্যাপক ও সর্বাত্মক পরিবর্তনের সূচনা করে। এই বিপ্লবের পশ্চাতে ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা অভাব অভিযোগ ও অসন্তোষ। বিশেষ করে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ।
১। তিনটি শ্রেণি : আঠারো শতকের ফরাসি সমাজ ছিল মধ্যযুগীয় ও সামন্ততান্ত্রিক। তৎকালীন ফ্রান্সের আর্থসামাজিক অসংগতি ও ত্রুটির মধ্যেই ফরাসি বিপ্লবের কারণ নিহিত ছিল। পূর্বতন সমাজব্যবস্থায় তিনটি সম্প্রদায় বা পৃথক এস্টেট ছিল। যাজক ও অভিজাত শ্রেণি ছিল যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট এবং অধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণি। সমাজের বাকি সকলকে নিয়ে গঠিত ছিল তৃতীয় এস্টেট বা অধিকারহীন শ্রেণি। ফরাসি সমাজে এই তিনটি শ্রেণির পৃথক অস্তিত্ব এই প্রথাসিদ মৌলিক নিয়মে পরিণত হয়। ভলতেয়ারের রচনায় এই তিনটি এস্টেট একটি জাতির মধ্যে তিনটি জাতি বলে বর্ণিত।
২। যাজকদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য : মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ না হলেও যাজকরা ছিল সুগঠিত শ্রেণি। এদের নিজস্ব শাসন ও বিচার ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত স্বার্থরক্ষার জন্য খাজকীয় সভা ছিল। রাজ্যের এক দশমাংশ ভূ-সম্পত্তি ছিল এদের দখলে। তাদের আদায়ীকৃত টাইথ (Tithe) বা ধর্মকরের পরিমাণ কম ছিল না। সারা বছরে এককালীন দেয় ‘স্বেচ্ছাদান ছাড়া এদের কর দিতে হত না। কিন্তু এদের মধ্যে এইসব সুযোগ সুবিধার অধিকারী ছিল ঊর্ধ্বতন যাজকরা, জন্মসূত্রে এরা ছিল অভিজাত বংশীয়। এরা বিত্তবান, ক্ষমতালোভী ও দুর্নীতিপরায়ণ। পারলৌকিক চিন্তার চেয়ে পার্থিব সুখের প্রতি এদের লালসা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু জন্মসূত্রে তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত নিম্নতম যাজকরা ছিল সমাজে অপাংক্তেয়। এরা নিম্নপদস্থ, তাদের বৃত্তির পরিমাণ খুব কম, দ্রুত পদোন্নতিও হত না। অথচ সমস্ত ধর্মীয় কর্তব্যের বোঝা ছিল তাদের ওপর। তাই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বেড়েই চলেছিল।
৩। অভিজাতদের সুযোগ-সুবিধার অসঙ্গতি : যোগ্যতা নয়, বংশকৌলিন্যই ছিল উচ্চ রাজপদ প্রাপ্তির প্রথম ও একমাত্র শর্ত। মোট জনসংখ্যার প্রায় দেড় শতাংশ হলেও দ্বিতীয় সম্প্রদায় বা অভিজাতরা ছিল।সবচেয়ে প্রভাবশালী। এদের দখলে ছিল এক পঞ্চমাংশ ভূ-সম্পত্তি। এরা ভোগ করত যাবতীয় উচ্চপদ একচেটিয়া অধিকার, করদান থেকে সম্পূর্ণ বা আংশিক অব্যাহতি, কৃষকদের ওপর ধার্য সামন্ততান্ত্রিক দেয় আদায়ের অধিকার ইত্যাদি। মধ্যযুগে রাজাকে প্রশাসনে অর্থ ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য ইত্যাদির বিনিময়ে ওইসব সুবিধার অধিকার তারা পেয়েছিল। কিন্তু সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ ও রাজক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ফলে তাদের কোনো কর্তব্য থাকল না অথচ তাদের সামস্ততান্ত্রিক সুবিধাগুলি অব্যাহত রইল। এজন্য জনগণের চোখে এই নিষ্কর্মার দল হেয় প্রতিপন্ন হয়েছিল। তাছাড়া, তারা ‘বনেদী', 'সভাসদ', 'পোশাকী’ ও ‘গ্রাম্য' ইত্যাদি বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও, তৃতীয় সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার এবং দম্ভ ও ঔদ্ধত্য প্রকাশে এরা এক ছিল। আর এজন্যই এদের প্রতি তৃতীয় সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ ছিল সীমাহীন। ষোড়শ লুই-এর রাজত্বকালে এই শ্রেণির দম্ভ ও উন্নাসিকতা সাধারণ মানুষকে বিপ্লবমুখী করে তোলে।
৪। কৃষক বা শ্রমিকদের অবস্থা ও তাদের অভিযোগ বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত, কৃষক ও শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত তৃতীয় সম্প্রদায়ের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের কোনো অধিকার ছিল না, ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না, কোনো প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থার মাধ্যমে অভাব অভিযোগ প্রকাশের অধিকারও ছিল না। সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এই শ্রেণি মাত্রাতিরিক্ত করভার বহন করত। এরা ছিল জনসংখ্যার শতকরা সাতানব্বই ভাগেরও বেশি। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃষকরা ছিল জনসংখ্যার প্রায় পঁচাত্তর ভাগ। এরা নানা উপশ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। স্বাধীন কৃষক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নিজস্ব ভূমি চাষ করত। আর ছিল ভাগচাষি ও ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। এদের প্রধান অভিযোগ ছিল দুর্বহ করের বোঝা আর কৃষিযোগ্য জমির স্বল্পতা। কৃষক ছাড়া ছিল শ্রমিক। মূলত শহরাঞ্চলে ছিল এদের বাস এবং এরা কলে কারখানায় কাজ করত। এদের প্রধান অভিযোগ স্বল্প মজুরি, চাকরির নিরাপত্তার অভাব ও বেকারত্ব। প্যারিস শহরে বিপ্লবকালীন হিংসাত্মক ঘটনার জন্য এরা প্রধানত দায়ী। এদের সঙ্গে অবশ্য যোগ দিয়েছিল বেকার কৃষক / শ্রমিক যারা ‘সাঁকুলেং' বা সর্বহারা নামে পরিচিত।
৫। বুর্জোয়াদের আশা-আকাঙ্ক্ষা : তৃতীয় সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ স্তরে ছিল বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এদের মধ্যে নানা উপশ্রেণি ছিল। বৃহৎ ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, শিল্পপতিদের বলা যায় উচ্চ বুর্জোয়া। শিল্প বাণিজ্যের দৌলতে এরা সবচেয়ে বিত্তবান শ্রেণি। নিম্ন বুর্জোয়া ছিল কারিগর ও ছোট ব্যবসায়ী। বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ আইনজীবী, অনভিজাত প্রশাসক, চিকিৎসক ইত্যাদি ছিল মধ্য বুর্জোয়া। সামগ্রিকভাবে বুর্জোয়াদের অভিযোগ ছিল বিদ্যা, বুদ্ধি ও অর্থসম্পদে বলীয়ান হলেও এরা তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের আন্তরিক বিশ্বাস ছিল যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্মান ও সুযোগ তাদের প্রাপ্য। এই আত্মসচেতন ও আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণির অভিমত ছিল—সামাজিক সম্মান ও স্বীকৃতির পরিমাপক হবে প্রকৃত যোগ্যতা, জন্মকৌলিনা নয়। এককথায়, অভিজাতদের সম-মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে ওঠাই ছিল তাদের আকাঙ্ক্ষা। নেপোলিয়ন যথার্থই বলেছিলেন, “অহমিকাই ছিল বিপ্লবের মূল কারণ, স্বাধীনতা ছিল অজুহাত মাত্র।"
৬। তৃতীয় এস্টেটের ক্ষোভের কারণ ও গুরুত্ব : (১) তৃতীয় এস্টেটের বুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত অনেকের আর্থিক অবস্থা অভিজাতদের তুলনায় সচ্ছল ছিল। কিন্তু বংশ কৌলীন্যের অভাবে এদের কোনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছিল না।
(২) কৃষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোনোরকম অধিকার ছিল না।
(৩) তৃতীয় এস্টেট ভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারহীনতা তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। পুরোনো ব্যবস্থার শৃঙ্খল ছিন্ন ন এই অবস্থার অবসানের কোনো পথ ছিল না।
৭। সামাজিক কারণের গুরুত্ব অনেকের মতে, সামাজিক বৈষম্য ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণ। এই কারণে তৃতীয় এস্টেট প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেটের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিল। নেপোলিয়নের মতে, অহমিকাই ছিল বিপ্লবের মূল কারণ, স্বাধীনতা ছিল অজুহাত মাত্র। গুডউইন বলেন, অভিজাতদের প্রতিক্রিয়াশীল আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই ফরাসি বিপ্লবের কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। রাইকার মনে করেন, বিপ্লব ছিল সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন।
Tags :