ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গঠন এবং কার্যাবলী || ভারতের বিচার বিভাগ অধ্যায়ের বড় প্রশ্ন উওর 2023
ভূমিকা :- ভারতের কেন্দ্রীভূত অখণ্ড বিচারব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে সুপ্রিমকোর্ট। আদালতকে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বলা হয়। সংবিধানের ১২৪-৯৪২ নং ধারাগুলিতে সুপ্রিমকোর্টের গঠন বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
[1] বিচারপতির সংখ্যা :
পার্লামেন্টের নতুন আইন (২০১১) অনুসারে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০ জন করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন প্রধান বিচারপতি এবং অন্য ৩০ জন সহকারী বিচারপতি । বতর্মানে (জানুয়ারি, ২০১৪) সর্বমোট ৩১ জন বিচারপতি নিয়ে সুপ্রিমকোট গঠিত হওয়ার কথা নতুন আইনে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনে সুপ্রিমকোর্ট অস্থায়ী বিচারপতি নিয়োগের কথা সংবিধানে বলা হয়েছে (১২৮ নং ধারা)।[2] বিচারপতিদের নিয়োগ:
সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। বিচারপতি নিয়োগের আগে রাষ্ট্রপতি দরকার মতো সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। এই পরামর্শ গ্রহণ করা রাষ্ট্রপতির পক্ষে বাধ্যতামূলক নয়। অবশ্য প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের আগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করা রাষ্ট্রপতির পক্ষে বাধ্যতামূলক। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অনেকটা তত্ত্বগত। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই নিযুক্তির কাজ সম্পন্ন করেন।[3] বিচারপতিদের যোগ্যতা, কার্যকাল ও পদচ্যুতি :
ভারতের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের যোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে-(i) বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ভারতের নার হতে হবে,
(ii) তাঁকে অন্তত পাঁচ বছর কোনো হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে কাজ করতে হবে অথবা ১০ বছর একাদিক্রমে কোনো হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করতে হবে অথবা রাষ্ট্রপতির বিবেচনা অনুযায়ী তাঁকে একজন প্রখ্যাত আইনজ্ঞ হতে হবে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্বপদে বহাল পারেন। কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে বা সংসদের প্রস্তাব অনুসারে রাষ্ট্রপতি তাকে পদচ্যুত করলে অথবা তাঁর মৃত্যু হলে। বিচারপতির পদ শূন্য হতে পারে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিকে পদচ্যুত করতে হলে ইমপিচমেন্ট পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগ-সংবলিত প্রস্তাব পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের মোট সদস্যসংখ্যার অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী। সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সমর্থিত হলে প্রস্তাবটি রাষ্ট্রপতির কাছে। পেশ করা হয়। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা ভারতে সঞ্চিত তহবিল থেকে দেওয়া হয়।
সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি:-
সুপ্রিমকোর্টের কার্যক্ষেত্রকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
[1] মূল এলাকা
[2] আপিল এলাকা
[3] পরামর্শদান এলাকা
[4] নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারির এলাকা।
[1] মূল এলাকা:
সংবিধানের ১৩১ নং ধারা অনুযায়ী, যেসব বিষয়ের মামলা হাইকোর্ট বা অন্য কোনো অধস্তন আদালতে দায়ের করা যায় না। সেইগুলি সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত। আইনগত অধিকারের প্রশ্নে-
(i) কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের বিরোধ বাধলে অথবা,
(ii) কেন্দ্রীয় সরকার এবং এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের সঙ্গে অন্যান্য কয়েকটি বা একটি রাজ্য সরকারের বিরোধ দেখা দিলে অথবা
(iii) দুই ও ততোধিক রাজ্য সরকারের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ দেখা দিলে একমাত্র সুপ্রিমকোর্টই তার নিষ্পত্তি করে। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতি/ বা উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংক্রান্ত যে-কোনো বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা সু সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত।
[2] আপিল এলাকা:
আপিল এলাকাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল, দেওয়ানি আপিল, ফৌজদারি আপিল এবং বিশেষ অনুমতিসূত্রে আপিল।i. সংবিধানের ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত আপিল:- সংবিধানের ১৩২ (১) ধারা অনুসারে দেওয়ানি ফৌজদারি বা অন্য যে-কোনো মামলায় হাইকোর্ট যদি এই মর্মে প্রমাণপত্র দেয় যে সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত, তাহলে ওই মামলার বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়। তা ছাড়া হাইকোর্ট এ ধরনের প্রমাণপত্র না দিলেও সুপ্রিমকোর্ট যদি মনে করে যে মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত, তাহলে সুপ্রিমকোর্ট নিজেই মামলাটির বিচারের জন্য আপিলের 'বিশেষ অনুমতি (Spe cial leave) দিতে পারে [১৩৬ (১) নং ধারা]।
ii. দেওয়ানি আপিল:
১৯৭২ সালে সংবিধানের ৩০তম সংশোধনের পর বর্তমানে কোনো দেওয়ানি মামলায় হাইকোর্ট যদি এই মর্মে প্রমাণপত্র দেয় যে সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে আইনের সাধারণ প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রশ্ন জড়িত, তাহলে সেই মামলাটির বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়। তা ছাড়া সংবিধানের ১৩৩(১) নং ধারা অনুসারে হাইকোর্ট যদি মনে করে যে, কোনো দেওয়ানি মামলার বিচার সুপ্রিমকোর্টে হওয়া উচিত তবে সেই মামলা সম্বন্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়।
iii. ফৌজদারি আপিল:- ফৌজদারি মামলার বিষয়ে তিনটি ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়, ডিক্রি বা চূড়ান্ত আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়- নিম্নতর আদালতের রায়ে নির্দোষ বলে প্রমাণিত কোনো ব্যক্তিকে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড দিলে, 2 নিম্ন আদালতে বিচার চলাকালীন কোনো মামলা নিজের হাতে তুলে নিয়ে ছাইকোর্ট অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে, 3) কোনো মামলা সুপ্রিমকোর্টে আপিলযোগ্য বলে হাইকোর্ট প্রমাণপত্র দিলে। তা ছাড়া বর্তমানে সংবিধানের ১৩৪(২) নং ধারা অনুসারে পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত ১৯৬৯ সালের একটি আইন অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি অথবা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যে-কোনো নাগরিক সুপ্রিমকোর্টে আপিল করতে পারে।
iv. বিশেষ অনুমতিসূত্রে আপিল: সংবিধানের ১৩৬(১) নং ধারা অনুযায়ী ভারতের সামরিক আদালত বা সামরিক ট্রাইব্যুনাল ছাড়া যে-কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালের রায়, আদেশ বা দন্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য সুপ্রিমকোর্ট 'বিশেষ অনুমতি দিতে পারে।
১৯৭৮ সালের ৪৪তম সংবিধান সংশোধনের পর থেকে হাইকোর্ট কোনো মামলার রায় দেওয়ার সময়েই সুপ্রিমকোর্টে আপিলের অনুমতি দিতে পারে, অথবা বিবদমান কোনো পক্ষের মৌখিক আবেদনের ভিত্তিতে তৎক্ষণাৎ আপিলের অনুমতি দিতে পারে।
[3] পরামর্শদান এলাকা:
সংবিধানের ১৪৩ (১) নং ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন আইন বা তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো সর্বজনীন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বা দিতে পারে তাহলে তিনি সে-বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের কাছে পরামর্শ চাইতে পারেন। এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট পরামর্শ দিতে বাধ্য নয়। তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শুনানির পর সুপ্রিমকোর্ট তার মতামত জানাতে পারে। তা ছাড়া সংবিধান চালু হওয়ার আগে সম্পাদিত সন্ধি, চুক্তি, অঙ্গীকারপত্র, সনদ ইত্যাদির মধ্যে যেগুলি সংবিধান চালু হওয়ার পরও বলবৎ রয়েছে, সেগুলির বিষয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চেয়ে পাঠাতে পারেন [১৪৩(২) নং ধারা]। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে সুপ্রিমকোর্ট বাধ্য।[4] নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারির এলাকা:
মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে তা বলবত্ ও কার্যকর করার জন্য নাগরিকরা সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করতে পারে। সুপ্রিমকোর্ট এই উদ্দেশ্যে বন্দি-প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকারপৃচ্ছা, উৎপ্রেষণ প্রভৃতি নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি করতে পারে।অন্যান্য ক্ষমতা:-
এ ছাড়াও সুপ্রিমকোর্টের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে। যেমন, সংবিধানের ১২৯ নং ধারা অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের অভিলেখ আদালত বা Court of Records হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে। বিভিন্ন মামলায় নিজের দেওয়া যে-কোনো রায় বা আদেশ পুনর্বিবেচনা করার অধিকারও সুপ্রিমকোর্টের আছে। সংবিধানের ১৪২(২) নং ধারা অনুযায়ী, আদালত অবমাননার জন্য সুপ্রিমকোর্ট অবমাননাকারীর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা করতে পারে। সংবিধানের ১৪১ নং ধারা অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক ঘোষিত বিধি অনুসরণ করা ভারতের সমস্ত আদালতের পক্ষে বাধ্যতামূলক। তা ছাড়া, যে-কোনো বিষয়ে পূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ডিক্রি ও আদেশ জারি করার ক্ষমতাও সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে। নিজের কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী নিয়োগের ক্ষমতাও সুপ্রিমকোর্টকে দেওয়া হয়েছে।# এই নোটটি ছায়া প্রকাশনীর সহায়িকা বই থেকে নেওয়া। তাই উপরিক্ত নোটটির প্রকৃত মালিক বইটির লেখকগন।